শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.
৩ আদিগীতিঃ ৩য় অংশ পুরাণ প্রসঙ্গ - মতুয়ার বার্তা

শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.

  • Breaking News

    হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা

    ➤ ১. সদা সত্য কথা বলবে। ➤ ২. পিতা-মাতাকে দেবজ্ঞানে ভক্তি করবে।➤ ৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে। ➤ ৪. জগতকে ভালোবাসবে।➤ ৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে। ➤ ৬. জাতিভেদ করবে না। ➤ ৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। ➤ ৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে। ➤ ৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে। ➤ ১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না। ➤ ১১. ষড়রিপু বশে রাখবে। ➤ ১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।

    ৩ আদিগীতিঃ ৩য় অংশ পুরাণ প্রসঙ্গ


                             আদিগীতিঃ ৩য় অংশ
    পুরাণ প্রসঙ্গ


    এবে শুন যে ভাবেতে এল গুরুচাঁদ।
    পূর্ব সূত্র করে ব্যক্ত শ্রী তারক চাঁদ।।
    লীলামৃত গ্রন্থ মাঝে তাহার প্রমাণ।
    মহাদেব পুত্র হন নিজে ভগবান।।
    ভবানীর পুত্র ইচ্ছা হইল অন্তরে।
    বিনয় বচনে কহে শিবের গোচরে।।
    শুনিয়ে মহেশ কহে ভবানীর প্রতি।
    আমার স্বরূপ বাণী শুনহে পার্বতী।।
    যখনে ছিলাম মোরা ক্রীড়ায় মগন।
    ময়ূরে পাঠায় তথা যত দেবগণ।।
    ময়ূরে হেরিয়া মনে পাই মহাতাপ।
    দেবসহ ময়ূরে দিলাম অভিশাপ।।
    সপত্নী গর্ভেতে কারো না হবে সন্তুতি।
    তব বাক্য কেমনে পালিব বল সতী।।
    তবে তোমা এক কথা কহি সুবদনী।
    পুণ্যক নামেতে ব্রত কর এবে ধনী।।
    অবশ্য ব্রতের ফল পাইবে নন্দন।
    অভীষ্ট পূরণ হবে শুনহ বচন।।
    শিব বাক্যে মহামায়া তাহাই করিল।
    ব্রত ফলে ভগবানে পুত্র রূপে পেল।।
    পার্বতীর ব্রত পূর্ণ হইল যেদিনে।
    স্নান করিবারে দেবী চলিল তখনে।।
    গৃহেতে পাতিয়ে শয্যা চলিল ভবানী।
    শয্যাপরে শিশু রূপে হরি চিন্তা মণি।।
    রক্তিম বরণ শিশু শোভে চারিকর।
    প্রাতঃসূর্যসম যেন প্রকাশিছে কর।।
    রূপের প্রভায় গৃহ করে আলোকিত।
    গৃহে এসে মহামায়া হন চমকিত।।
    রূপ হেরি মহাদেবী ভাবে মনে মন।
    ব্রত ফল দান বুঝি কৈল নারায়ণ।।
    ত্রস্তচিতে হৈমবতী পুত্র নিল কোলে।
    শঙ্কর স্বকাশে ভাষে অতি কুতূহলে।।
    এস নাথ পুত্র মুখ কর দরশন।
    দয়া দান কৈল বুঝি প্রভু নারায়ণ।।
    অপরে পাইল বার্তা দেবতা মণ্ডলী।
    শিব সুতে হেরিবারে চলে কুতূহলী।।
    সকল দেবতা এল না আইল শনি।
    মনে মনে অসন্তোষ হইল ভবানী।।
    অন্তরেতে গ্রহরাজ সকল জানিল।
    নারায়ণে হেরিবারে প্রস্তুত হইল।।
    ব্যস্তচিতে গ্রহরাজ পথে যাত্রা করে।
    জায়া করে যাত্রা ভঙ্গ স্বামী বরাবরে।।
    সেইদিন ছিল গ্রহজায়া ঋতুমতী ছিল।
    ঋতু রক্ষা কর বলে শনিকে বলিল।।
    গ্রহরাজ বলে ইহা না বল এখন।
    হেরিতে পার্বতী সুত করেছি গমন।।
    শনির রমণী বলে ধরহ বচন।
    অভিলাষ পূর্ণ করিকরহ গমন।।
    শনি বলে হেন ভাষ না বলিও আর।
    পারিব না পুরাইতে বাসনা তোমার।।
    ক্রোধচিত্তে গ্রহরাজ গমন করিল।
    শনির রমণী অতি কোপান্বিতা হল।।
    বলে মম বাঞ্ছা পূর্ণ না করি হেথায়।
    ক্রোধিত হইয়ে তুমি চলেছে কোথায়।।
    অদ্য গিয়ে যাকে তুমি করিবে দর্শন।
    স্কন্ধ হতে মুণ্ড তার হইবে পতন।।
    না শুনি নারীর বাক্য শনির গমন।
    অবিলম্বে উপনীত শিবের ভবন।।
    যবে শনি শিব সুতে দর্শন করিল।
    স্কন্ধচ্যুৎ হয়ে মুণ্ড ভূমেতে পড়িল।।
    দরশনে দেবগণ হইল স্তম্ভিত।
    হায় হায় একি দশা হল আচম্বিত।।
    সেই মুণ্ড চলি যায় গণ্ডকী পর্বতে।
    কীট রূপে শনি যায় মুণ্ড সাথে সাথে।।
    খণ্ড খণ্ড করি ফেলে গণ্ডকীর জলে।
    যেই শিলা শালগ্রামে পূজ্য ভূমি তলে।।
    এদিকেতে মহামায়া করে হায় হায়।
    দিয়ে নিধি কেন ছলা কর দয়াময়।।
    কত না কঠোর ব্রত করি উদযাপন।
    নারায়ণ করে মম বাঞ্ছা সম্পুরণ।।
    শনি কেন কোপ দৃষ্টে দর্শন করিল।
    সে কারণ পুত্র মোর জীবন ত্যজিল।।
    পুত্র শোকে মহামায়া করেছে রোদন।
    স্বভীত হইত তাহে যত দেবগণ।।
    ব্রহ্মা বলে শুন যত দেবতা নিশ্চয়।
    উত্তর শিয়রি দেখ কে কোথা আছয়।।
    আনিয়ে তাহার মুণ্ড দেহ মম ঠাই।
    জীয়াব পার্বতী সুতে মুণ্ড যদি পাই।।
    নন্দী প্রতি দেবগণ আদেশ করিল।
    উর্দ্ধশ্বাসে নন্দী ভৃঙ্গি ধাইয়া চলিল।।
    ইন্দ্রের গজেন্দ্র শিরে গজমতী ছিল।
    উত্তর শিয়রি গিয়ে তাহাকে দেখিল।।
    আনিয়ে তাহার মুণ্ড ব্রহ্মা ঠাই দিল।
    স্কন্ধ পরে সেই মুণ্ড হরিষে ধরিল।।
    মুণ্ড স্পর্শে গণদেব সজীব হইল।
    গজানন নামে তাহে হরি হরি বল।।

    মহাদেবের প্রতিজ্ঞা ও গুরুচাঁদের জন্ম বিবরণ

    এইভাবে গজানন জনম লভিল।
    পার্বতীর মহাব্রত পূরণ হইল।।
    সেই দিন মহাদেব মাহাকাব্য কয়।
    নারায়ণ হল যদি আমার তনয়।।
    কেমনে শোধিব আমি এই ঋণ ধার।
    কতদিনে হব আমি শ্রীহরি কুমার।।
    গরুড় রূপেতে আমি বহি নারায়ণ।
    বৃষভ রূপেতে হরি আমার বাহন।।
    কেমনেতে এই ঋণ পরিশোধ হব।
    পিতা বলে নারায়ণে কবে বা ডাকিব।।
    প্রতিজ্ঞা করিয়ে বলে দেব পঞ্চানন।
    নিশ্চয় হইব আমি হরির নন্দন।
    ত্রেতাযুগে জন্ম প্রভু দশরথ ঘরে।
    আপন প্রতিজ্ঞা শিব শোধিতে না পারে।।
    রাবণের ভক্তিবলে আজ্ঞাধীন ছিল।
    সে কারণ এই বাঞ্ছা পুরাতে নারিল।।
    দ্বাপরে সুযোগ নাহি পেল ভোলানাথ।
    প্রতিজ্ঞা পুরাতে নারে ঘটিল ব্যাঘাত।।
    কতবার কত যুগ গত হয়ে যায়।
    স্বয়ং এর অবতার তাতে নাহি নয়।।
    অষ্টবিংশ মন্বন্তরে প্রতিজ্ঞা পূরণ।
    ত্রিপুরারী হল হরিচাঁদের নন্দন।।
    ইহার প্রমাণ হরি লীলামৃতে আছে।
    ক্ষীরোদ  বিহারী হরি মানব হয়েছে।
    অনাদি ঈশ্বর মোর প্রভু গুরুচাঁদ।
    অনাদি আদি প্রভু শ্রীশ্রীহরিচাঁদ।।
    আদি হতে অংশ তাই অনাদি ঈশ্বর।
    গুরুচাঁদ রূপধারী সর্ব সারাৎসার।।
    তাহাও লিখেছে মোর কবি রসরাজ।
    গুরুচাঁদ দেহে হরিচাঁদের বিরাজ।।
    আত্ম বৈজযুতে পুত্র স্বরূপ শকতি।
    পুরাণে রয়েছে তাহা ব্যাসের উকতি।।
    পিতাই বিন্দু রূপেতে জায়ার গরভে।
    রূপক মাত্রেন পুত্র প্রকাশে এ ভবে।।
    পিতার অঙ্গজ পুত্র সর্ব শাস্ত্রে কয়।
    অংশরূপে প্রকাশেন রূপেতে তনয়।।
    সে সব লিখিতে পুঁথি বেড়ে যায়।
    বাল্মীকি পুরাণে তার প্রমাণ আছয়।।
    আর এক কথা মম জাগিল হৃদয়।
    যে কালেতে হরিচাঁদ অন্তর্হিত হয়।।
    অনেক ভকত তথা উপনীত ছিল।
    প্রভুর বিয়োগে সবে কাঁদিতে লাগিল।।
    ভক্তগণ দুঃখ হেরি হরি দয়াময়।
    শূন্য থেকে শূন্য বাণী কহে সে সময়।।
    সম্বর রোদন এবে ভকত গণ।
    গুরুচাঁদ দেহে আমি হইনু মিলন।
    অনেকেই জানে সেই শ্রীমুখের বাণী।
    হরিগুরুচাঁদ এক দেহধারী তিনি।।
    আরো বলি শুন এক অপূর্ব কাহিনী।
    একদিন শুনেছিনু গুরুচাঁদ বাণী।
    হরি কথা কহে গুরুচাঁদ দয়াময়।
    বহু ভক্তগণ শুনে আনন্দ হৃদয়।।
    হেনকালে এল তথা এক যে রমণী।
    অতি বয়ঃবৃদ্ধা হয় নাম দুর্গামণি।।
    প্রভুপদে সেই ধনী প্রণাম করিল।
    গুরুচাঁদ হর্ষচিত্তে তাহাকে বলিল।।
    কেবা তুমি ওগো মেয়ে কোথা তব ঘর।
    কাহার নন্দিনী তুমি কিবা নাম ধর।।
    সেই মেয়ে বলে তবে শুন সমাচার।
    পুইশুর গ্রামে মম পিতার আগার।।
    মম পিতা শিবু ঢালী মম মাতা গৌরী।
    দুর্গামণি নাম মম তাদের কুমারী।।
    প্রভু বলে ওগো মেয়ে আমি তোর পিতা।
    দুর্গামণি বলে কেন কহ হেন কথা।।
    তোমা হতে মম পিতা ন্যুন কভু নয়।
    কেন আমি পিতা বলে শুধাব তোমায়।।
    গুরুচাঁদ বলে তবে শুন বাছাধন।
    হরিচাঁদ পুত্র আমি হই কোন জন।।
    কেহ নাহি চিনে মোরে কেবা হই আমি।
    জানে না আমি যে হই ত্রিজগৎ স্বামী।।
    মহাদেব বলে মোরে লিখেছে তারক।
    আমি হই একমাত্র ভব নিস্তারক।।
    একাদশ রুদ্র শিব শাস্ত্রের প্রমাণে।
    দ্বাদশ রুদ্রের কর্তা কেহ নহে জানে।।
    আত্ম পরিচয় আমি কহি তব পাশ।
    যে জানিবে তাহার কাটিবে কর্ম ফাঁস।।
    দ্বাদশ রুদ্রের আদি আমি মহীতলে।
    সেই বার্তা কেহ নাহি জেনে কোনকালে।।
    সেই কথা কহে প্রভু আপনার মুখে।
    ভক্তগণ শুনিলেন প্রেমানন্দ সুখে।।
    যেই দেহে ক্ষীরোদের হরি সম্মিলন।
    ভেবে দেখ গুরুচাঁদ হল কোন জন।।
    গুরুচাঁদ কেবা হয় তাহা নহে জানি।
    হরিহর অভেদাত্মা শাস্ত্রেতে বাখানি।।
    নির্দিষ্ট করিয়া বল কি লিখিব আমি।
    গুরুচাঁদ রূপে হর ত্রিজগৎ স্বামী।।
    যখনেতে গুরুচাঁদ ভূমিস্ট হইল।
    দৈব এক পক্ষী এসে চালেতে পড়িল।।
    পক্ষী বলে এল ভবে জগত রঞ্জন।
    এইবার করিবেন প্রতিজ্ঞা পূরণ।।
    কেহ নাহি জানে এই পক্ষী বিবরণ।
    আমি যেন করিলাম স্বকর্ণে শ্রবণ।।
    বার শএকান্ন সালে গুরুবার দিনে।
    উদয় জগতগুরু সে ঐশান্য কোণে।।
    হইল মহান রুদ্র ভুবনে প্রকাশ।
    পাপ তাপ দূরে গেল তিমির বিনাশ।।
    চারিদিকে হয় শুধু জয় জয় ধ্বনি।
    আনন্দ সাগরে যেন ভাসিল ধরণী।।
    হেনভাবে গুরুচাঁদ জনম লভিল।
    হরিগুরুচাঁদ প্রীতি হরি হরি বল।।

    মহাপ্রভু গুরুচাঁদের বিদ্যাভ্যাস

    শ্রীহরি অঙ্গজ শান্তি মায়ের উদরে।
    দেবাদিদেবের জন্ম উড়িয়া নগরে।।
    শান্তি হরি পাইলেন এ হেন নন্দন।
    শিবের প্রতিজ্ঞা এবে হইবে পূরণ।।
    শৈশবেতে খেলাধুলা হল সমাপন।
    শান্তি মাতা হরিচাঁদে বলেন তখন।।
    গুরুচাঁদে বিদ্যাভ্যাসে দিতে কও মন।
    লেখাপড়া শিখাইতে করহ যতন।।
    মোল্লাকাঁদি বাসী ভক্ত গোলক কীর্তুনে।
    গুরুচাঁদে রাখে ভালো তাহার ভবনে।।
    গোলোকের দুই পুত্র গিরি ও মথুর।
    গুরুচাঁদে ভাল তারা বাসয় প্রচুর।।
    একসনে বিদ্যাভ্যাস করিবে সবাই।
    তারাও দেখিবে ওকে যেন ভাই ভাই।।
    তাহাই হইল পরে রাখে মোল্লাকাঁদি।
    গিরিধর ক্ষণে ক্ষণে আসে ওঢ়াকাঁদি।।
    এক সনে খেলাধুলা আহার বিহার।
    একসনে নিদ্রা যায় আনন্দ অপার।।
    ক্ষণে ক্ষণে গিরি সনে বাক্য যুদ্ধ করে।
    শুনিলে আনন্দ বাড়ে সবার অন্তরে।।
    বাবা হরিচাঁদ বলে ডাকে গিরিধর।
    গুরুচাঁদ শুনে ক্রোধে করে গর গর।।
    বলে তোরে সাবধান হতে বলি শোন।
    আমার বাবাকে বাবা না কস কখন।।
    আমার বাবাকে যদি পুনঃ কস বাবা।
    মাথা ছিলে দিব তোর মেরে এক থাবা।।
    গিরি কহে নহে তোর একেলার বাপ।
    তোর বাপ মোর বাপ কেন মনস্তাপ।।
    গুরুচাঁদ বলে  তোর মাথা ছিঁড়ে দিব।
    দাদা বলে তোরে আমি কভু না ছাড়িব।
    এই ভাবে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করে দুইজন।
    মারামারি ধরাধরি করিত কখন।।
    পুনঃ দোঁহে হইতেন একত্র মিলন।
    পুরবাসীগণ হত আনন্দে মগন।।
    বিশুদ্ধ ভাবেতে দোঁহে করে প্রেমকেলি।
    ক্ষণে দোঁহে নৃত্য করে হরি হরি বলি।।
    বড়ই মধুর ভাব অপূর্ব মিলন।
    বর্ণনা অতীত তাহা কে করে বর্ণন।।
    গিরিধর গুরুচাঁদ বিরক্তি করিত।
    বাবা বলে পুনঃ পুনঃ সম্মুখে ডাকিত।।
    পুনরায় গুরুচাঁদ ক্রোধে কম্পমান।
    বলে তুই মম ঠাই হোস সাবধান।।
    পুনঃ যদি বাবা কস মারিব তুহারে।
    না জানিস বিরক্তি যে করিস কাহারে।।
    রাগে যেন কম্পমান হত গুরুচাঁদ।
    গিরির জননী শুনে পাইত আহ্লাদ।।
    ধেয়ে এসে গুরুচাঁদে কোলেতে করিত।
    গিরিধর এসে মাকে জড়িয়ে ধরিত।।
    বলিতেন নেমে আয় মার কোল হতে।
    পা ধরিয়ে আস্তে আস্তে টানে দুই হাতে।।
    গুরুচাঁদ বলিতেন দেখ দেখ ও মা।
    গিরিধর বলে দেখি দেখ কাহার মা।।
    গুরুচাঁদ বলে তুই মা পেলি কোথায়।
    দূর হ নহে ত লাথি মারিব মাথায়।।
    গিরির জননী তাহে আনন্দ লভিত।
    হৃদিমাঝে প্রেমবন্যা উথলে উঠিত।।
    এইভাবে বাল্যখেলা কিংবা বিদ্যাভ্যাস।
    তাহাতেই হইত কত ভাবের উচ্ছ্বাস।।
    গুরুচাঁদ বিদ্যাভ্যাস অপূর্ব কথন।
    প্রেমানন্দে শান্তি হরি বল সর্বজন।।

    ভক্ত যুধিষ্ঠিরের বাওয়াল করণ

    শ্রীশ্রীহরিচাঁদের দেশে ভক্ত যুধিষ্ঠির।
    বাওয়াল করিতে মতি করিলেন স্থির।।
    পুরাতন তরী ছিল ঘাটেতে ডুবান।
    প্রভু বলে সেচ তুমি এই ডোবা যান।।
    শ্রীগুরুচরণ বালা সে বাহিয়ে তরী।
    চালাতে নারিয়ে রাখে জলমগ্ন করি।।
    সেই তরী নিয়ে তুমি বাওয়ালে যাবা।
    বাওয়াল করিয়ে পুনঃ গৃহেতে আসিবা।।
    প্রভু বাক্যে যুধিষ্ঠির বলেছে বচন।
    শ্রীচরণে ওহে প্রভু এই নিবেদন।।
    বাদাবনে আছে যারা তাদের গাত্রেতে।
    পারিব কি নিঃসন্দেহে হস্ত প্রদানিতে।।
    প্রভু বলে অকপটে কহিনু তোমায়।
    নিঃসন্দেহে সে বাসনা পুরাব তথায়।।
    অনুক্ষণ থেক তুমি আমাকে ভাবিয়ে।
    তব অঙ্গ পরশিয়ে যাবে পালাইয়ে।।
    এমত আদেশ পেয়ে রঙ্গ যুধিষ্ঠির।
    গৃহে গিয়ে সঙ্গীগণে করি লয় স্থির।।
    পুনঃ এসে নৌকা সেচে লইল তখন।
    ঠাকুরে প্রণাম করি করিল গমন।।
    অন্য অন্য বাওয়ালী সাজিল সঙ্গেতে।
    দক্ষিণ দেশেতে চলে অতীব রঙ্গেতে।।
    বাদার নিকট গিয়ে নঙ্গর করিল।
    দ্বাবিংশতি নৌকা ক্রমে একত্র হইল।।
    দেড় মাস দুই মাস গত হয়ে যায়।
    তথাপি সে যুধিষ্ঠির চকে না ভিড়ায়।।
    সঙ্গীগণ বড় ব্যস্ত হইল সকলে।
    বিরক্তি হইয়ে যুধিষ্ঠির প্রতি বলে।।
    দুই মাস বসে বসে সময় কাটাই।
    বাওয়াল করিব কবে বুঝিয়ে না পাই।।
    এইভাবে যদি হেথা বসে বসে খাই।
    না খেয়ে মরিব শেষে জেনে রেখ তাই।।
    যুধিষ্ঠির বলে চিন্তা করনা কখন।
    সময় হইলে আমি নামিব তখন।।
    প্রভুর আদেশ নিয়ে এসেছি বাদায়।
    কিবা করে দেখি হরিচাঁদ দয়াময়।।
    যখনেতে কৃপা করে আদেশ করিবে
    তখনেতে সব কর্ম সমাধা হইবে।।
    এইমত বলে কয়ে সবাকে বুঝায়।
    নিশিযোগে নিদ্রাযোগে সবাই ঘুমায়।।
    একমাত্র যুধিষ্ঠির নিদ্রা নাহি যায়।
    কৃপা করি দেখা দেন  হরি দয়াময়।।
    আগা নৌকা চরাটেতে বসি হরিচাঁদ।
    যুধিষ্ঠিরে ডাকিতেছে অন্তরে আহ্লাদ।।
    যুধিষ্ঠির জানিলেন সব বিবরণ।
    আগা নৌকা পরে গিয়ে প্রণমে তখন।।
    প্রভু বলে শোন্‌ বাপ আমার বচন।
    কাটা গাছ রহিয়াছে তথা পাঁচ পোণ।।
    বরই বুনিয়া নামে চক্‌ আছে এক।
    সত্বরে বাহিয়ে তরী তথা গিয়ে দেখ।।
    সঙ্গীগণে সে গাছের তুল্য অংশ দিবি।
    অন্যথা হইলে শেষে বিপদে পড়িবি।।
    মৃত মুণ্ড কংকালাদি দেখিতে পাইবি।
    কিন্তু তাতে কোন মনে শঙ্কা না করিবি।।
    আমার বচনে আর বিল্মব কর না।
    সত্বরে ডাকিয়ে লও সঙ্গী সব জনা।।
    এত বলি হরিচাঁদ অন্তর্ধান হৈল।
    যুধিষ্ঠির ত্রস্তচিতে সবাকে ডাকিল।।
    চক্‌মন নামে ছিল সঙ্গী একজন।
    সব কথা সেই জনা করেছে শ্রবণ।।
    সেইজন সবাকারে ডাকিয়ে লইল
    কেহ বলে কোথা যাব রজনী যোগেতে।
    যেথা বলে সেথা যাব রজনী প্রভাতে।।
    চক্‌মন বলে মিছে না করিও দ্বন্দ্ব।
    তরণী চালাও সবে হইয়ে আনন্দ।।
    বড় সুপ্রভাত হবে নিশি অদ্যকার।
    বাওয়াল হইবে শুভ চিন্তা নাহি আর।।
    এত শুনি আর কেহ বিরক্ত না করি।
    চালাইয়ে দিল তরী বলে হরি হরি।।
    বরই বুনিয়া চকে হইল উদয়।
    নদীকূলে কাটা গাছ দেখিবারে পায়।।
    যুধিষ্ঠির বলে হেথা লাগাও তরণী।
    কেহ বলে ওই দেখ কংকালের খনি।।
    মৃত মুণ্ড কংকালাদি দেখা যায় কত।
    ব্যাঘ্রের কবলে সবে হয়েছে নিহত।।
    ওখানে বাঁধিলে তরী নিশ্চয় মরিব।
    বাওয়ালে কাজ নাই দেশে ফিরে যাই।
    চক্‌মন বলে কেন এত ভয় মনে।
    রক্ষাকারী আছে এক মোদের পিছনে।।
    তরণী বাঁধহ এই কাটা গাছ সনে।
    এই গাছ আমাদের জান সর্বজনে।।
    অনন্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যাহার সৃজন।
    তাহার কৃপায় মোরা আছি এ ভুবন।।
    তিনি করেছেন আজ্ঞা আসিতে হেথায়।
    কেন মিছিমিছি সবে পাও এত ভয়।।
    এত বলি সেই গাছে তরণী বাঁধিল।
    ক্রমে ক্রমে সর্বজন নীরব হইল।।
    মনে ভয় কখনেতে কি যেন কি হয়।
    এত গাছ কেটে তারা মরেছে সবায়।।
    যদি তার একজন জীবিত থাকিত।
    তা হলে এ গাছ তারা অবশ্য লইত।।
    এইমত আনাগোনা করে মনে মনে।
    মনে ভাবে কেন বা এলাম বাদাবনে।।
    ইতি উতি নানা কথা ভাবে সর্বজন।
    হরি বলে যুধিষ্ঠির নামিল তখন।।
    ঠাকুরের দত্ত রুল হস্তেতে করিয়ে।
    যুধিষ্ঠির তীরে নামে শ্রীহরি বলিয়ে।।
    কাটা গাছ পরে গিয়ে বসিল তখন।
    হরিচাঁদ রূপ চিন্তা রসেতে মগন।।
    গাছের ভিতর হতে শার্দূল ভীষণ।
    বাহির হইল এক করিয়ে গর্জন।।
    যুধিষ্ঠির বলে বাপ দাঁড়া ওইখানে।
    আসিয়াছি প্রভু হরিচাঁদের বচনে।।
    এত বলি ব্যাঘ্র পৃষ্ঠে বুলাইল হাত।
    নিস্পন্ধ হইয়া ব্যাঘ্র রহে তৎক্ষণাৎ।।
    আধ ঘণ্টা কাল প্রায় রহিল তথায়।
    সঙ্গীগণ নেহারিয়া মূর্ছা প্রাপ্ত হয়।।
    মনে ভাবে এইবার ধরিয়ে লইবে।
    আজ আর রক্ষা নাই মরিয়েছি এবে।
    এত ভাবি সর্বজনে হয় অচেতন।
    সবে মাত্র চেতন রয়েছে চক্‌মন।।
    চেয়ে দেখে ব্যাঘ্রবর কিছুদূর গিয়ে।
    ভীষণ চীৎকার করি চলিল ছুটিয়ে।।
    চক্‌মন সবাকারে করায় চেতন।
    বলে তোরা মিছিমিছি কেন অচেতন।।
    পালিয়েছে ব্যাঘ্রবর বনের মাঝারে।
    ওই দেখ কর্তা বসে গাছের উপরে।।
    এমত আশ্বাস বাক্যে চৈতন্য হইল।
    যুধিষ্ঠির চক্‌মনে ডাকিয়া বলিল।।
    গাছ ভরিবার তরে কর আয়োজন।
    হরিচাঁদ নামধ্বনি কর সর্বজন।।
    এত বলি চক্‌মন তাহাই করিল।
    সব সঙ্গীগণ যেন জীবন পাইল।।
    ক্রমে তারা সুস্থচিত্তে তীরেতে নামিল।
    যুধিষ্ঠির প্রতি চক্‌মন জিজ্ঞাসিল।।
    কি বলিয়ে গেল ওই বনের রক্ষক।
    কেন বা করেছে ধ্বংস এই সব লোক।।
    যুধিষ্ঠির বলে রাখে ঠাকুরের জন্যে।
    কেমনে লইবে তাহা বল এসে অন্যে।।
    তিন মাস আমা তরে রয়েছে হেথায়।
    বহু বাওয়ালীর প্রাণ হয়ে গেছে ক্ষয়।।
    এক মাস এই চক্‌ ছুটি দিয়ে গেছে।
    এক দিন বেশী হলে উপায় না আছে।।
    তাড়াতাড়ি গাছ ভরি লহ সর্বজন।
    ধর ধর লও লও ওহে সঙ্গীগণ।।
    এইমত বার বার বলিল যখন।
    সুস্থচিত্তে গাছ ধরে যত সঙ্গীগণ।।
    বড় বড় গাছ দেয় ঠাকুরের নায়।
    অপরেতে অন্য গাছ সবে তুলে লয়।।
    কেনাই নামেতে সঙ্গী যুধিষ্ঠির সাথ।
    বৃহৎ পশরী গাছে যবে দিল হাত।।
    ঝোঁক এসে সেজনার বলেছে তখন।
    এই গাছ নহে তোরা পাবি অন্যজন।।
    আমার জামাতা পাবে এই গাছ খানি।
    দিবি কিনা দিবি তারে বল আমি শুনি।।
    যুধিষ্ঠির বলে কেবা জামাতা তোমার।
    কৃপা করি আমাদিগে বল একবার।।
    সেজন বলেছে তুই কেন না চিনিস।
    কার আজ্ঞা পেয়ে তুই বাদায় আসিস্‌।।
    কেবা তোরে বলে দিল গাছের সন্ধান।
    কার কৃপাবলে অদ্য পাইলি পরাণ।।
    আমার জামাতা হয় অমূল্য রতন।
    ওঢ়াকাঁদি করে বাস ভক্ত প্রাণধন।।
    এইমত বাক্য শুনি কাঁদে যুধিষ্ঠির।
    চক্‌মন কেঁদে কেঁদে হইল অস্থির।।
    ক্রমে ক্রমে সর্বজন করিয়ে বিনয়।
    সকাতরে চক্‌মন ধীরে ধীরে কয়।।
    ওগো মাতা বনদেবী চরণে জানাই।
    কুশলে রাখেন যেন তোমার জামাই।।
    এই গাছ দিব মোরা প্রভু হরিচাঁদে।
    কৃপা করি মো সবাকে রেখ নিরাপদে।।
    সফল হয়েছি কম আর বেশী নাই।
    স্থানে স্থানে বৈসে কত জানে তা সবাই।।
    সেই সব স্থান মোরা কেমনে এড়াব।
    ধরিলে কুতের টাকা কেমনেতে দেব।।
    বনদেবী বলে কুত লাগিবে না কভু।
    রক্ষা করি নিয়ে যাবে হরিচাঁদ প্রভু।।
    জামাতার নামে ধ্বনি করিয়ে যতনে।
    সায়ারে জোয়ার দিস্‌ মিলি সর্বজনে।।
    কেহ আর না ডাকিবে নিঃসন্দেহে যাবি।
    আমার জামাতা গুণ অনুক্ষণ গাবি।।
    স্বীকার করিল সবে করিয়ে বিনয়।
    ঝোঁক সম্বরিল তারে তুলিল নৌকায়।।
    ধরাধরি করি গাছ নৌকায় তুলিল।
    সব নৌকা রীতিমত বোঝাই হইল।।
    সুস্থচিত্তে সর্বজন আহারাদি কৈল।
    চারিদিকে হতে সব বাওয়ালী ছুটিল।।
    শতাধিক নৌকা এসে বাঁধিল তখন।
    বিনয় করিয়া তারা বলেছে বচন।।
    বড় রাগী চক হয় বরই বুনিয়া।
    কত বাওয়ালী এসে গিয়েছে মরিয়া।।
    কত জন নাম শুনে পালাইয়া গেল।
    কেবা এই রাগ চকে বাওয়াল করিল।।
    কার নামে ফাড়া বাঁধ কে হয় বাওয়ালী।
    কৃপা করি কহ মোরা সবে কৃতাঞ্জলি।।
    চক্‌মন বলে ফাড়া যার নামে বাঁধি।
    তিনি হেথা আসে নাই আছে ওঢ়াকাঁদি।।
    আজ্ঞাবহ মহাজন আছে একজন।
    বাওয়াল করিনু মোরা তাহার কারণ।।
    বলে সবে কই তিনি বারেক দেখিব।
    তার কাছে দুটো কথা আমরা শুনিব।।
    বোঝাই নৌকাতে আসে বাওয়ালীগণ।
    নিষেধ করিলে তবু না শুনে বারণ।।
    যুধিষ্ঠির প্রতি কথা কহে চক্‌মন।
    বাহিরেতে একবার আসুন এখন।।
    এত লোক ভিড় হলে কুলাবেনা আর।
    বিপদ হইতে পারে ভাবনা আমার।।
    এত শুনি যুধিষ্ঠির বাহিরে দাঁড়ায়।
    যত বাওয়ালীরা এসে প্রণমিল পায়।।
    সবিনয়ে বলে যত বাওয়ালীগণ।
    কি করিব মোরা সবে বল হে এখন।
    বড় রাগ এই চকে মোরা তাই জানি।
    বহু বাওয়ালীরগণ হারায় পরাণি।।
    যুধিষ্ঠির বলে একমাস ছুটি আছে।
    একদিন বেশী হলে না আসিও কাছে।।
    প্রণামি দানিল যত বাওয়ালীর গণ।
    হরিচাঁদ নাম ধ্বনি করে সর্বজন।।
    সবে বলে ধন্য হরিচাঁদ দয়াময়।
    উদ্দেশ্য প্রণাম করি ঠাকুরের পায়।।
    এইভাবে বহুক্ষণ অতীত হইল।
    হরি বলে সায়ারে জোয়ার ধরে দিল।।
    মহাবেগে চলে তরী নদীর মাঝার।
    সবে করে হরিরূপ চিন্তা অনিবার।।
    আড়োমোঙলা ত্রিমোহনা যখনে আইল।
    উল্ট জল বেঁধে তরী টোটায় উঠিল।।
    মাটির ভিতর ঢুকে গেল সেই স্থান।
    থর থর কাপে তরী ভয়ে কম্পমান।।
    যুধিষ্ঠির আগে আগে ছিল অন্য নায়।
    উচ্চৈঃস্বরে ডাকে সবে করে হায় হায়।।
    বার হাত ডিঙি এক তাহে উঠে এল।
    ছয় জন ছয় বৈঠা হাতে করে নিল।।
    যুধিষ্ঠির বলে টান দাও হরি বলে।
    নেমে যাবে নেমে যাবে হরিনাম বলে।।
    এদিকেতে শুন এক অপূর্ব কথন।
    শ্রীধামেতে এসেছিল ভক্ত একজন।।
    খড়মখালী নিবাসী শ্রীকৃষ্ণ বেপারী।
    সন্তান বাঁচেনা তার তাহে দুঃখ ভারি।।
    ঠাকুরের কাছে এল জানাইতে তাই।
    শ্রীরাম নিবাসী হয় তার জ্যেষ্ঠ ভাই।।
    যজ্ঞেশ্বর নাম হয় নন্দন তাহার।
    তাহাই সম্বল মাত্র ভ্রাতা দুজনার।।
    মন দুঃখে কৃষ্ণধন শ্রীধামেতে এল।
    অপরূপ কাণ্ড এক তথায় দেখিল।।
    প্রভু হরিচাঁদ অতি ব্যস্ত চিতে উঠি।
    দক্ষিণ পুকুর পাড়ে চলিলেন হাঁটি।।
    স্বজোরে মারেন লাথি কম্পে বসুমতী।
    পুনঃ পুনঃ মহাপ্রভু মারে তিন লাথি।।
    শ্রীকৃষ্ণ বেপারী তাই দেখিতে পাইল।
    মনে ভাবে কেন লাথি ঠাকুর মারিল।।
    কোন কিছু নাহি দেখি না বুঝি কারণ।
    পুনঃ পুনঃ মারে লাথি কেন অকারণ।।
    ঠাকুর আইল যবে জিজ্ঞাসে তখন।
    লাথি কেন মারিলেন বলুন এখন।।
    দয়াময় বলে শুনে কিবা প্রয়োজন।
    বলিতে হইবে পুনঃ বলে কৃষ্ণধন।।
    প্রভু বলে শুন তবে ওহে বাছাধন।
    আমার আদেশেতে যুধিষ্ঠির যায় বন।
    গাছ ভরি সায়ারে জোয়ার ধরিছে।
    আড়মোঙলা মোহনায় বিপদে পড়েছে।।
    মাটির ভিতর ঢুকে গাছ ভরা নাও।
    কেঁদে কহে হরিচাঁদ বিপদে বাঁচাও।।
    লাথি দিয়ে সেই তরী দিনু নামাইয়ে।
    ছয়জনে বাহে বৈঠা হরিধ্বনি দিয়ে।।
    কৃষ্ণধন শুনে এই অপূর্বকাহিনী।
    বলে তোমা বুঝিলাম ওহে চিন্তামণি।।
    এত যদি জান তুমি ওহে দয়াময়।
    আমার দুঃখের কথা কহিব তোমায়।।
    জেনে শুনে যাহা কর ওহে অন্তর্যামী।
    আপন আবাসে প্রভু চলিলাম আমি।।
    এত বলি কৃষ্ণধন চলিল আবাসে।
    ওদিকেতে যুধিষ্ঠির কহে মৃদুভাষে।।
    ছয়জন দাও টান বলে হরি হরি।
    ঠাকুরের কৃপা হলে নেমে যাবে তরী।।
    এত বলি ছয়জন টানে প্রাণপণে।
    সত্বর নামিল তরী ঠাকুরের গুণে।।
    শতাধিক লোকে যাহা প্রয়োজন হবে।
    প্রভুর কৃপায় তাহা নাহি লাগে এবে।।
    পুনরায় বাহে তরী হরি হরি বলি।
    বহুদূর এল বেয়ে সবে কুতূহলী।।
    পথিমধ্যে নানাস্থানে কুত বসিয়েছে।
    না ডাকিবে এই তরী রাখিলেও কাছে।।
    চিত্তিরা নদীর গোড়ে তরণী বাঁধিল।
    কোন নৌকা বড় নদী বাহিয়া চলিল।।
    যুধিষ্ঠির বলে সবে এই নদী দিয়ে।
    এত বলি সেই স্থানে রহিল বাঁধিয়ে।।
    রাত্রিকালে জোয়ারের জোর হইয়েছে।
    ঠাকুরের তরী বেয়ে তখনে চলেছে।।
    শ্রীকৃষ্ণ বেপারী বসি থাকে নদীকূলে।
    যুধিষ্ঠির দেখে বসে মনেতে ভাবিলে।।
    কেমন মানুষ তারে হেরিব নয়নে।
    হেন কর্ম করে প্রভু যাহার কারণে।।
    এতবলি বসি রয় নদীর কুলেতে।
    ঠাকুরের তরী এল প্রভাত কালেতে।।
    ডেকে বলে কোথা বাস বাওয়ালীরগণ।
    তরী রাখ তরী রাখ শুনহ বচন।।
    কার নামে ফাড়া বাঁধ কে হয় বাওয়ালী।
    কার নাম নিয়ে তরী বাহ কুতূহলী।।
    চক্‌মন বলে ফাড়া যার নামে বাঁধি।
    তিনি তো রয়েছে ভাই শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি।।
    কৃষ্ণধন বলে হয় হয় তাহা জানি।
    কৃপা করি এই ঘাটে লাগাও তরণী।।
    আড়োমোঙলা হতে যবে বাঁচায় সঙ্কটে।
    তখনেতে ছিনু আমি প্রভুর নিকটে।।
    এত শুনি সর্বজনে বিস্মিত হইল।
    খড়মখালীর ঘাটে তরণী বাঁধিল।।
    সবিশেষ বার্তা শুনে কৃষ্ণধন ঠাই।
    কেঁদে কেঁদে সর্বজন ছাড়িতেছে হাই।।
    অতপর বলে কয়ে বিদায় লইল।
    হরিধ্বনি দিয়ে সবে তরণী বাহিল।।
    ক্রমে গিয়া নিজ বাসে উপনীত হল।
    বাদার সংবাদ গিয়ে ঠাকুরে বলিল।।
    গাছ ভরা নৌকা গিয়ে ঘাটে লাগাইল।
    পশুরীর গাছ সবে দেখিতে আইল।।
    এমন বৃহৎ গাছ না দেখি না শুনি।
    সবে শুনিলেন সেই অপূর্ব কাহিনী।।
    ক্রমে ক্রমে সব গাছ নামায় ত্বরিতে।
    মড় মড় শব্দ তাহে উঠে নৌকা হতে।।
    যখনেতে সব গাছ ওলান হইল।
    আস্তে আস্তে তরীখানি খসিয়া পড়িল।।
    আশ্চর্য গণিল সবে করিয়ে দর্শন।
    একি ভাব নাহি বুঝি ইহার কারণ।।
    কেমনে এ হেন নৌকা বাদায় চলিল।
    কেমনে বা এত গাছ আনিতে পারিল।।
    প্রভুর অপার লীলা বোঝে সাধ্য কার।
    চমৎকার হতে লীলা অতি চমৎকার।।
    অসাধ্য সাধন করে প্রভু দয়াময়।
    এ লীলা রহস্য ভবে বড় মধুময়।।
    বর্ণিতে নাহিক সাধ্য লিখে কি জানাব।
    বিঁধি বিষ্ণু মহেশ্বরর মাগে পরাভব।।
    তরী সেই ভাবে তথা ডুবিয়া রহিল।
    গলই দুটাকে শুধু খসাইয়ে নিল।।
    সে গলই অদ্যাবধি শ্রীধামে রয়েছে।
    অতীব যতন করি গৃহে রাখিয়েছে।।
    তৈল মেখে রাখে ঘরে কত না আদরে।
    একদিন মহাপ্রভু দেখাইলেন মোরে।।
    এইভাবে করে লীলা লীলাময় হরি।
    হরিগুরু প্রেমানন্দে বল হরি হরি।।

    গোস্বামী লোচনের পদ্মানদীতে ঢেউ খেলা অন্তে শ্রীধামে গমন

    অতপর শুন এক অপূর্ব কথন।
    পদ্মানদী মাঝে চলে গোস্বামী লোচন।।
    ঢেউ খেলিবারে সেই নদীর মাঝারে।
    টুণ্ডা হস্তে বেয়ে চলে বৈঠা ধরি করে।।
    বাণিজ্য করিতে যায় সদাগরগণ।
    পথিমধ্যে তাহাদের সঙ্গে দরশন।।
    টুণ্ডা হস্তে বেয়ে চলে সবে দেখে তাই।
    জিজ্ঞাসা করেছে কোথা যাও হে গোঁসাই।।
    গোঁসাই বলেছে আমি পদ্মামাঝে যাব।
    তরঙ্গ খেলিব আর হরিগুণ গাব।।
    শুনিয়া নাবিক গণ করে উপহাস।
    ব্যঙ্গভরে করে কত বাক্যের বিন্যাস।।
    সামান্য খালের ন্যায় নহে পদ্মা নদী।
    ভগ্ন তরী যাবে ডুবে তথা যাও যদি।।
    মাসাবধি লাগিবে সে পদ্মা পৌছিতে।
    বাকী আর রাখিবেনা টুণ্ডা হাতে যেতে।।
    যাওয়া মাত্র পদ্মানদী লইবে তোমারে।
    কেন তুমি যাও বল মরিবার তরে।।
    কেহ বলে হাসি পায় শুনিয়ে বচন।
    যাওয়া মাত্র পদ্মানদী লইবে জীবন।।
    ফিরে যাও ও গোঁসাই ভাল যদি চাও।
    পদ্মামাঝে যাইবার তুমি যোগ্য নও।।
    এইমত উপহাস করেছে সবাই।
    হরিচাঁদ বলে তরী বাহিল গোঁসাই।।
    নাবিকেরগণ তাহে করে আনাগোনা।
    টুণ্ডা বেটা ফিরিয়ে আসিতে পারিবেনা।।
    এইমত সবে তারা বলিতে লাগিল।
    অবিলম্বে গোস্বামীজী পদ্মায় পৌছিল।।
    পদ্মামাঝে ঢেউ খেলে আনন্দিত মনে।
    বাড়িল প্রেমের বন্যা গঙ্গা দরশনে।।
    মকর বাহিনী গঙ্গা ভাসিতে ভাসিতে।
    নৌকার নিকট এল আসিতে আসিতে।।
    সবে দেখা টুণ্ডা বেটা তরঙ্গ খেলায়।
    ভীষণ তরঙ্গ মাঝে ভাসিয়ে বেড়ায়।।
    ক্ষণেকে অদৃশ্য হয় ক্ষণে যায় দেখা।
    তীরে থেকে বহুলোক করে আঁকাবাঁকা।।
    এ বেটা মরিল ভাই দেখ সর্বজন।
    কিছুতে না এ বেটার বাঁচিবে জীবন।।
    মরিতে আইল কে ভগ্ন তরী বেয়ে।
    গোস্বামীকে গালি দেয় কোন কোন নেয়ে।।
    হরি বলে ভাসে সাধু আনন্দ গোলায়।
    গঙ্গার সহিত তিনি তরঙ্গ খেলায়।।
    কৌতূহল হেরে কেহ দাঁড়িয়ে কিনারে।
    কেহ কয় টুণ্ডা বেটা এল মরিবারে।।
    দেখিতে দেখিতে সাধু কিনারে আইল।
    হেরিতে মহাপুরুষে অনেকে ধাইল।।
    গোস্বামীকে হেরে কেহ হইল বিস্মিত।
    বলে প্রভু কর হেথা বিল্মব কিঞ্চিত।।
    গোঁসাই বলেছে আমি ওঢ়াকাঁদি যাই।
    বিল্মব করিতে নারি শুন ওহে ভাই।।
    এত বলি চলে সাধু তরণী বাহিয়া।
    বহুলোক রহিলেন বিস্মিত হইয়া।।
    দ্রুত বেগে চলে তরী হেরে সর্বজন।
    কেহ বলে নিশ্চয় হইবে মহাজন।।
    পূর্ব নাবিকের সনে পথে দরশন।
    তারা বলে একি ভাই না বুঝি কারণ।।
    কেহ বলে ঢেউ দেখে আইল ফিরিয়ে।
    টুণ্ডা হাতে পদ্মা মাঝে যাবে কি করিয়ে।।
    কেহ বলে তত্ত্ব জেনে দেখ ওরে ভাই।
    মনে বলে সামান্য না হইবে গোঁসাই।।
    কেহ বলে ও গোঁসাই তরঙ্গ কেমন।
    গোঁসাই বলেছে ভাই যে দেখে যেমন।।
    এত বলি গোস্বামীজী বাহিয়ে চলিল।
    অবিলম্বে ওঢ়াকাঁদি উদয় হইল।।
    ঠাকুরে হেরিয়ে বলে ও হরি ও হরি।
    পদ্মার তরঙ্গ মাঝে তোমারে নেহারি।।
    গুরুচাঁদে বলে ভাই শুন হে বচন।
    সর্ব অগ্রে ওঢ়াকাঁদি করেছি গমন।।
    শুনিয়ে শ্রীগুরুচাঁদ বলেন তখন।
    অতি অস্মভব কথা না বল এমন।।
    এত বলি বৈঠা খানি নিলেন কাড়িয়া।
    টুণ্ডা বলে গালাগালি দিলেন রুষিয়া।
    অসন্তুষ্ট হইলেন লোচন গোস্বামী।
    অন্তরে জানিল তাহা প্রভু অন্তর্যামী।।
    হরিচাঁদ বলে ভাষা গোস্বামীর প্রতি।
    বালক বলিয়া ক্ষমা কর মহামতি।।
    বালক বুদ্ধিতে কিছু বলে গুরুচাঁদ।
    মমপানে চেয়ে না লইও অপরাধ।।
    গোস্বামী বলেছে হরি কেন বল তাই।
    কেন হব অসন্তোষ ওযে মোর ভাই।।
    তোমার এ লীলা খেলা কেবা বোঝে হরি।
    কখনেতে কিবা খেল কোন রূপ ধরি।।
    কে জানে তোমার তত্ত্ব ওহে দয়াময়।
    কি লাগিয়ে কিবা কর এ বিশ্ব ধরায়।।
    এমত বিনয় বাক্য কহে শ্রীলোচন।
    বড়ই সন্তোষ হন কমল লোচন।।
    মন দুঃখ দূরে গেল গোস্বামী হাসিল।
    গোস্বামীর মনানন্দে হরি হরি বল।।

    মহা প্রভু হরিচাঁদের তিলছাড়া গমন

    একদিন হরিচাঁদ ভক্তগণ সনে।
    চলিলেন তিলছড়া আনন্দিত মনে।।
    সঙ্গে চলে গুরুচাঁদ অত্যানন্দ ভরে।
    উপনীত হইলেন কৈলাসের ঘরে।।
    আনন্দে পুর্ণিত হিয়া কৈলাস তখন।
    নয়নেতে প্রেমধারা হতেছে পতন।।
    কৈলাসের নারী করে বিপুল ভকতি।
    সবে মিলে হইলেন আনন্দিত অতি।।
    হেনকালে উপনীত শ্রীবংশী বদন।
    ভক্তিচিত্তে  বন্দিলেন প্রভুর চরণ।।
    হরিকথা শ্রবণেতে হল ভাবোদয়।
    শ্রীবংশী গাইন কেঁদে ধরণী লোটায়।।
    শ্রীমুখের বাক্য শুনি সবে মাতোয়ারা।
    অবিশ্রান্ত ভাবে দুনয়নে বহে ধারা।।
    নীরবেতে কাঁদে বংশী প্রভুর সদন।
    প্রভুকে লইতে গৃহে করেছে মনন।।
    তথা হতে চলিলেন ভকত রঞ্জন।
    অগ্রে গিয়ে পথে রৈল শ্রীবংশীবদন।।
    বংশীর নয়নে ধারা বহে শতধারে।
    উপনীত হরিচাঁদ বংশীর গোচরে।।
    হেনকালে এল তথা ভক্ত চারিজন।
    রাউৎখামার হয় বসতি ভবন।।
    শ্রীচৈতন্য হীরামন আর গিরিধর।
    শ্রীঅক্রুর বালা এল প্রভুর গোচর।।
    চারিজন প্রভুপদে প্রণাম করিল।
    পরে শ্রীচৈতন্য বালা কহিতে লাগিল।।
    হীরামন বড় ত্যক্ত করে সকলেরে।
    দয়া করে একবার তাকে দাও সেরে।।
    প্রভু বলে তুমি সেরে থেক মহাশয়।
    আত্মসেরে যেবা থাকে নাহি তার ভয়।।
    অন্যের সারিতে গেলে বড় জ্বালা পায়।
    সারিতে পারেনা ঘটে বিষম সংশয়।।
    এতেক বলিয়ে চলে বংশীর গৃহেতে।
    বিপুল আনন্দ হল বংশীর হৃদেতে।।
    বসিয়ে গৃহের মাঝে হরি দয়াময়।
    ভক্তসনে রসরঙ্গে হরিকথা কয়।।
    ওদিকেতে সঙ্গোপনে বংশীর রমণী।
    রন্ধন করিতে বসি একাকিনী।।
    কেহ নাহি জানে তাহা রেঁধেছে একেলা।
    কেঁদে বলে ওহে প্রভু আমি সে অবলা।।
    হরিমুখে হরি কথা বড়ই মধুর।
    ভক্তগণে মহাশান্তি পাইল প্রচুর।।
    এ ভাবে কিছু সময় অতীত হইল।
    বংশী ঠাই হরিচাঁদ বিদায় চাহিল।।
    বংশী কহে যেতে কেবা নিষেধ করিবে।
    রন্ধন হয়েছে ঘরে কেবা তা সেবিবে।।
    প্রভু বলে একি কহ রাঁধিলে কখন।
    বংশী বলে তব কৃপা হইল যখন।।
    প্রভু বলে দাও তবে করিব ভোজন।
    মাকে এনে দিতে বল সে অন্ন ব্যঞ্জন।।
    শ্রুত মাত্র এনে দিল বংশীর রমণী।
    ভক্তসনে করে ভোজ হরি গুণমণি।।
    আনন্দের ভোজ করিয়া হল সমাপন।
    বাহিরে নাচিছে সেই শ্রীবংশী বদন।।
    প্রভু বলে এই কর্ম বড় চমৎকার।
    বিশুদ্ধ ভক্তির ধর্ম হয় সর্বসার।।
    সেবা বিনে সিদ্ধ বস্তু কভু নাহি মিলে।
    সেবাই পরম ধর্ম ভক্তিতে সেবিলে।।
    অষ্ট প্রকারেতে সেবা সর্বশাস্ত্রে কয়।
    ভোজন ভজন শ্রেষ্ঠ জানিও নিশ্চয়।।
    সময় বুঝিয়ে সেবা করে যেইজন।
    অকামনা প্রেমভক্তি পায় সেই জন।।
    বুঝিয়ে করিবে কর্ম বাড়ে প্রেমানন্দ।
    অন্তিমে পাইবে সেই রাতুল আনন্দ।।
    এইভাবে সেই গৃহে ভোজন করিল।
    রাউৎখামার বাসী সবে চলে গেল।।
    বংশীর রমণী প্রভু পদে লোটাইল।
    নয়ন জলেতে বক্ষ প্লাবিত হইল।।
    (এক লাইন জ্ঞাপ)
    সান্তনা করিয়ে প্রভু তাহাকে শুধায়।
    পতিপদে আছে ভক্তি তোমার হৃদয়
    আনন্দে থাকিও মাতা কিবা আছে ভয়।।
    এইভাবে করে প্রভু প্রেম বিতরণ।
    গুরুচাঁদ পদ ভাবি কহে বিচরণ।।


    No comments:

    Post a Comment

    শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত

    শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা

    শ্রীশ্রীহরিসঙ্গীত গান

    শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.