পরিশিষ্ট
খণ্ডঃ চতুর্থ তরঙ্গ
পরিশিষ্ট খণ্ড
চতুর্থ তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
চতুর্থ তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
(জয় শ্রীসুধন্যচাঁদ সভ্যভামাত্মজ।
প্রেমানন্দে হরি গুরু শ্রীপতিচাঁদ ভজ।।)
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
*প্রস্তাবনা*
রামকান্ত বলে হরি ধরাতে উদয়।
যশোমন্তদেব গৃহে সফলাডাঙ্গায়।।
প্রশস্ত গার্হস্থ ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
অবতীর্ণ হরিচাঁদ আসি অবনীতে।।
ধর্মের নামেতে জীব অধর্ম করয়।
ধর্ম দুঃখী তাই দেখি শ্রীহরি উদয়।।
নামধর্ম নিয়ে এল শ্রীগৌরাঙ্গ রায়।
‘অনিত্য সংসার’বলি জীব শিক্ষা দেয়।।
আদর্শ দেখাতে গোরা সন্ন্যাসী হইল।
সংসারের জীব কিন্তু সংসারে রহিল।।
‘রাইপ্রেম’ ‘রাধারস’ বলি
গোরা কাঁদে।
‘নারীপ্রেমে’ বুঝি ভক্ত পড়ে মোহ ফাঁদে।।
জগত তারিতে এসে সংসার ছাড়িল।
সংসার ‘সং’ সার হ’ল জগত
ডুবিল।।
সংসারের মাঝে তাই গৃহস্থ সাজিয়া।
হরিচাঁদ অবতীর্ণ নামধর্ম নিয়া।।
শৌচাচার, কুটিনাটি শিক্ষাদীক্ষামন্ত্র।
সংকীর্তন মধ্যে যথা ডুগডুগি যন্ত্র।।
বজ্রস্বরে ঘরে ঘরে হরিচাঁদ কয়।
“শোনরে কলির জীব, আর নাই ভয়।।
সংসারে সংসারী থাক তা’তে ক্ষতি নাই।
চরিত্র পবিত্র রাখি সত্য বলা চাই।।
গৃহ ধর্ম রক্ষা কর বাক্য সত্য কও।
হাতে কাম মুখে নাম দেল্-খোলা হও।।
অসতের সঙ্গ ছাড়ি হরি হরি বল।
কুফল বিফল হবে পাবে প্রেমফল।।
পুরুষে করিবে ভক্তি পিতামাতা ভাই।
নারী পক্ষে পতি ভিন্ন অন্ন গতি নাই।।
পরপতি পরসতী স্পর্শ না করিবে।
না ডাক হরিকে হরি তোমাকে ডাকিবে।।
গৃহ ধর্ম গৃহকর্ম সকলি করিবে।
হাতে কাম মুখে নাম ভকতি রাখিবে।।
গৃহধর্ম রক্ষা করে বাক্য সত্য কয়।
যোগী, ন্যাসী কি সন্ন্যাসী কেহ তুল্য নয়।।
গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়।
সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।।”
তারস্বরে প্রভু যবে এই ভীর দিল।
রোগী ভোগী দুঃখী পাপী সকলি আইল।।
বাল্যেতে করিল প্রভু গোচারণের খেলা।
গার্হস্থ ধর্মের ভিত্তি গোধনের মেলা।।
ধ্যানমগ্ন হরিচাঁদ বালক বয়সে।
ছত্ররূপে শিররক্ষা করে ফণী এসে।।
প্রতিবেশী নারী এক তাহা দৃষ্টি করে।
অন্নপূর্ণামাতা ভীতা মন্দ চিন্তা করে।।
শীঘ্র করি হরিচাঁদে বক্ষেতে লইল।
সর্পেতে দংশিল নাকি জিজ্ঞাসা করিল।।
হরিচাঁদ বলে “মাগো! বৃথা কর ভয়।
আমাকে দংশিবে সর্প একি কভু হয়।।”
বালকের ছলা ভাবি জননী আশ্বস্ত।
চক্ষু নাহি দেখে কভু ললাট প্রশস্ত।।
কৈশোরে রাখাল সনে সখ্য ভাবে লীলা।
অন্তরঙ্গ বিশ্বনাথে প্রাণদান দিলা।।
কৈশোরের শেষ হ’ল প্রথম যৌবনে।
শান্তিদেবী আসি মিলে শান্তিময় সনে।।
ব্রজনাথ দেহে যেই কৃষ্ণশক্তি ছিল।
হরিচাঁদ অঙ্গে আসি মিলিত হইল।।
‘বার’ করে বিষ্ণুশক্তি সফলাডাঙ্গায়।
আকর্ষণে হরিচাঁদ দেহে হ’ল লয়।।
ক্রমে ক্রমে বিকশিত ঈশ্বরীয় শক্তি।
ভবিষ্যৎ বলে স্বপ্নে কুষ্ঠব্যধিমুক্তি।।
জমিদার সঙ্গে বাদ দেশ ত্যাগী হ’ল।
পূর্ণ লীলাক্ষেত্র ওঢ়াকাঁদিতে আসিল।।
ভাই ভাই ঠাই ঠাই বাড়ী হ’ল ভিন্ন।
জ্যেষ্ঠ পুত্র গুরুচাঁদ হয় অবতীর্ণ।।
ব্যবসায় কৃষিকার্য করে ইতিপূর্বে।
শেষ করিলেন হরি গৃহস্থালি পর্বে।।
আপন আত্মাকে হরি আপনি দেখিলা।
কত লীলা করে হরি চটকার তলা।।
কল্পবৃক্ষ মূলে বসে শ্রীহরিঠাকুর।
অকামনা, নামে রুচি কামবাঞ্ছা দূর।।
অকামনা বৃক্ষমূলে মিলে সর্বফল।
অকামনা ব্রত সাধে ভকত বৎসল।।
একা প্রভু বহু হ’ল ভক্তের দেহে।
ভক্তি আকর্ষণে চলে ভক্তগণ গৃহে।।
প্রথম নিশানা করে রাউৎখামার।
শ্রীবংশীবদন শ্রীরামলোচন আর।।
ওঢ়াকাঁদি রামচাঁদ চৌধুরী সুজন।
পদে পদ্ম দেখি মত্ত হ’ল সেইজন।।
রোগী, ভোগী, ভকত, বাদী সকলে
জুটিল।
যুগাবতারের কাজ আরম্ভ হইল।।
যুগে যুগে অবতার জীবের কারণ।
শ্রীহরিরূপেতে ওঢ়াকাঁদি আগমন।।
*শ্রী শ্রী হরিচাঁদ প্রণাম
প্রণাম তোমায়, ওগো বিভু (প্রভু) হরিচাঁদ।
তব নাম স্মরণেতে ঘোচে কর্মফাঁদ।।
প্রেমের ঠাকুর হরি, চির, চিদানন্দময়।
সভক্তি প্রণাম লহো ওহে কৃপাময়।।
হরিচাঁদ! মুক্তিদাতা, পালক সবার।
প্রেমগুণে বাঁধিয়াছে জগৎ-সংসার।।
লীলাময় কল্পতরু, ভক্তাধীন হরি।
ভক্তিভরে তবপদে প্রণিপাত করি।।
অনন্ত মহিমা তব অনন্ত ভুবনে।
সবকালে সর্বারাধ্য জানে ভক্তজনে।।
নিজগুণে দয়াময় দাও পদে ঠাই।
তবপদে হরিচাঁদ প্রণাম জানাই।।
ওঢ়াকাঁদি মহাতীর্থ, তোমার কারণে।
চিরধন্য ভক্তবৃন্দ রূপ-দরশনে।।
‘মহানন্দ’ ‘তারকের’ হৃদয়ের
ধন।
প্রণাম তোমায় হরি, নর-নারায়ণ।।
‘হরিনাম’ মহামন্ত্র করিয়া প্রচার।
শান্তি সুধা বিতরিলে নাশি পাপভার।।
‘সর্বজীবে প্রেমদয়া’ তব শিক্ষা হয়।
প্রণাম তোমায় হরি সর্বগুণময়।।
হরিচাঁদ! তুমি পিতা, পতিত পাবন।
তোমায় প্রণাম করি সত্য-সনাতন।।
চিরবন্ধু! দীননাথ সর্বজনগতি।
তবপদ শতদলে জানাই প্রণতি।।
*আত্মানুভূতি ও আত্মদর্শন
ঠেকিয়া জীবের দায় জীবদেহ ধরে।
জীব শিক্ষা লাগি জীবোচিত কর্ম করে।।
গৃহস্থের মূলভিত্তি অর্থনীতি বটে।
(এক লাইন গ্যাপ)
বাণিজ্য করিয়া হরি শিখায় সকলে।
গৃহী কত বড় হয় ব্যবসায়ী হ’লে।।
মুনি ঋষি করে চাষ আরয ব্যবসায়।
একদিন চাষ করি প্রভু তা’ শিখায়।।
বহিরঙ্গ শিক্ষা বটে এবে শেষ হ’ল।
আপনার কাজ মনে প্রভুর পড়িল।।
পঞ্চ ভাই পৃথগন্ন দুই বাড়ী ভিন্ন।
আমভিটা ‘পরে প্রভু নহে মনঃক্ষুণ্ণ।।
অন্তরঙ্গ সঙ্গে মিশি দিবা রাত্রি যায়।
ঠাকুরের তিন কন্যা জন্মে এ সময়।।
শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ প্রভু-পুত্র জ্যেষ্ঠ।
আমভিটা বাসকালে হ’লেন ভূমিষ্ঠ।।
গুরুচাঁদ জন্ম পরে প্রভুজী উদাস।
সংসার ফেলিয়া দূরে স্বরূপ প্রকাশ।।
ভ্রাতৃগণ অনুরোধে আমভিটা ছাড়ি।
ওঢ়াকাঁদি আসিলেন পোদ্দারের বাড়ী।।
এ সময় মহাপ্রভু একা ঘুরে ফিরে।
একদিন চলেন প্রভু জয় নগরে।।
আড়োকান্দী মাঠ মধ্যে তুলি উচ্চ শির।
বকুলের গাছ এক দাঁড়াইয়া স্থির।।
সন্ধ্যার অগ্রেতে প্রভু কি জানি কি ভাবি।
বসিলেন বৃক্ষমূলে চিন্তা মাঝে ডুবি।।
অনন্ত ‘আপন’ মাঝে প্রভু ডুবে রয়।
আপন স্বরূপ প্রভু দেখিবারে পায়।।
মহান পুরুষরূপে আপনার আত্মা।
প্রভুর সম্মুখে আসি কহিলেক বার্তা।।
“নামধারী দেহ রূপে তুমি হরিচাঁদ।
জীব শিক্ষা লাগি নর জগতের নাথ।।
তুমি স্থুল আমি সূক্ষ্ম উভয়ে অভিন্ন।
দেহ আত্মা মোরা দোঁহে মূলে নহি ভিন্ন।।
গৃহধর্মে সুআদর্শ সব দে’য়া হ’লে।
দেহ গৃহ শুচিকার্য জীবে কি বুঝিলে।।
দেহ মন নহে শুচি গৃহধর্ম করে।
ছিদ্রযুক্ত তরীসম ডুবে যে সাগরে।।
দেহ মন সর্বক্ষণ রাখিতে পবিত্র।
শিখাইতে হবে জীবে সেই মূলসূত্র।।
তুলিয়া নামের ঢেউ প্রেম প্লাবনেতে।
ধু’য়ে মুছে নি’ব সব নাম প্রবাহেতে।।
শুদ্ধাচারী, বীজমন্ত্রী, নামে জপে মালা।
একা একা যেতে চায় সমুদ্রেতে ভেলা।।
গুরুরূপে ব্যবসায়ী কাণে দেয় মন্ত্র।
প্রাণহীন দেহ যেন জুড়ে অঙ্গে যন্ত্র।।
এসব সামান্য কূপ সবে ডুবে যা’বে।
হরিপ্রেম প্লাবনেতে জীব মুক্তি পা’বে।।
দেহ মন শুদ্ধ হ’বে স্থির হবে আত্মা।
তখন শিখা’তে হ’বে গৃহধর্ম কথা।।
দৃষ্টিপাত করি দেখ তব গৃহমাঝে।
গুরুচাঁদ রূপে বিশ্বনাথ আসিয়াছে।।
জগদ্ধাত্রী-পতি যিনি স্বর্ণকাশী বাস।
শিখা’তে গার্হস্থ নীতি এল কৃত্তিবাস।।
প্রেমপ্লাবনেতে মাটি সরস হইবে।
সোনার ফসল তাহে আবাদে ফলিবে।।”
এইভাবে নিশি ভোর ভাবে অচৈতন্য।
আত্মস্থ হইল প্রভু জীব মুক্তি জন্য।।
প্রভাতে জাগিয়া প্রভু গৃহপানে যায়।
অসার সংসার বলি সব মনে হয়।।
সংগসারকে ‘সং’ ভাবি প্রভু ছেড়ে দিল।
‘সং’ মধ্যে ‘সার’
দিতে গুরুচাঁদ এল।।
নামে ‘ভীর’ দিল প্রভু পাষণ্ড উতলা।
কবি কহে পাতকীর আর নাহি জ্বালা।।
*তিরোভাব ও মিলন
নরদেহ আবরণে হরিচাঁদ বিভু।
পুত্ররূপে গুরুচাঁদ আপনি স্বয়ম্ভু।।
আত্মদরশন করি প্রভু হরিচাঁদ।
আপনা বিলা’তে কাটে সংসারের ফাঁদ।।
পবিত্র গার্হস্থ ধর্ম জীবে শিক্ষা দিতে।
গৃহী থেকে পারি কই ভাবিলেন চিতে।।
পবিত্র চরিত্র হ’বে গৃহস্থের মূল।
মূলভিত্তি স্থুল হ’লে সব অনুকূল।।
কৃষি বাণিজ্যাদি বটে শিখা’ল স্বহস্তে।
এক দেহে গুরুভার শিখানো গৃহস্থে।।
কা’কে ভার দি’ব প্রভু ভাবে মনে মন।
চেয়ে দেখে সঙ্গে এল কোন কোন জন।।
রুদ্রশক্তি হীরামনে দেখিবারে পায়।
বৃহস্পতি শক্তি নিয়ে এল মৃত্যুঞ্জয়।।
শিবশক্তি শ্রীগোলোক নারিকেল বাড়ী।
কৃষ্ণশক্তি শ্রীলোচন ঘুরে বাড়ী বাড়ী।।
প্রহলাদ-আহলাদ নিয়ে দশরথ হয়।
বিশ্বনাথ, ব্রজ, নাটু, রাখাল
নিচয়।।
অংশ অবতার যত পূর্বেতে আইল।
‘আমি পূর্ণ’ জানি তারা সকলে জুটিল।।
মম শক্তি বহিবার এরা নহে যোগ্য।
‘ভাবনা অতীত’ আমি নাহি দৃশ্য, ভোগ্য।।
খণ্ড অবতারে যে’বা এল ধরা’পরে।
আপনা রাখিতে পূর্ণ ভজিল আমারে।।
রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, আদি
অথবা গৌরাঙ্গ।
আমাকে সাধনা করে পেতে মম সঙ্গ।।
‘পূর্ণ আমি’ সর্বময় ‘অপূর্ণের
পিতা’।
‘সাধনা, আমার কন্যা আমি জন্মদাতা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ হরি বলে রাম পূজে দুর্গা।
শ্রীকৃষ্ণের প্রেম দিল রাধিকা বিসর্গা।।
বুদ্ধের তপস্যা লাগে ‘বুদ্ধ’ সাজিবারে।
বিনা সাধনায় এরা কিছু নাহি পারে।।
আমি হরিচাঁদ এবে পূর্ণ অবতার।
অজর, অমর, আমি ক্ষীরোদ-ঈশ্বর।।
মম শক্তি ধরিবারে কারো সাধ্য নাই।
ধরিলে ধরিতে পারে মহাদেব সাঁই।।
ধরিয়া অনন্ত কাল ক্ষীরোদ সাগরে।
মুনিরূপে ধ্যান করে পাইতে আমারে।।
অংশ অবতার মোর যতবার হয়।
কোন বারে মহাদেব আসেনা ধরায়।।
ইচ্ছা তাঁর পূর্ণ অবতার যবে হবে।
আসিয়া আমার খেলা আনন্দে খেলিবে।।
এত ভাবি’ হরিচাঁদ শঙ্করে স্মরিল।
করজোড়ে মহাকাল সম্মুখে দাঁড়া’ল।।
হরিচাঁদ বলে “দেব-দেব মহাদেব।
মম ইচ্ছা গৃহধর্মী জীবকে তরা’ব।।
চিত্তশুদ্ধি একাগ্রতা বীর্যবত্তা লাগি।
সংসারী সাজিয়া আমি সাজিব বিরাগী।।
আদর্শ গৃহীসাজে তোমাকে সাজা’ব।
মম কার্য শেষ করি তোমাতে মিশিব।।
আমা তোমা দুই শক্তি একত্র হইবে।
পাপী তাপী যোগীন্যাসী সবে ছায়া পাবে।।”
মহাদেব বলে “নাথ! যে আজ্ঞা তোমার।
মনের বাসনা আমি পুরা’ব এবার।।
পুত্ররূপে তব ঘরে নরদেহ ল’ব।
শান্তিমাতা বক্ষ সুধা পিয়ে ধন্য হ’ব।।”
সেই হেতু পুত্ররূপে এল গুরুচাঁদ।
মহাকাল গুরুচাঁদ পিতা হরিচাঁদ।।
গুরুচাঁদ জন্ম পরে প্রভু সাজে দীন।
সংসার বাসনা দিনে দিনে হ’ল ক্ষীণ।।
ক্রমে ক্রমে হরিচাঁদ বিরাগী সাজিল।
সংসারের ভার গুরুচাঁদ হস্তে নি’ল।।
ত্রিংশ বর্ষ বয়ঃক্রম যখনে হইল।
গৃহস্থের গূঢ়নীতি সব শিক্ষা হ’ল।।
আদর্শ গৃহস্থ সাজে প্রভু গুরুচাঁদ।
মনে মনে মহাপ্রভু পাইল আহ্লাদ।।
পূর্বের প্রতিজ্ঞা মত দিন কাছে এল।
গুরুচাঁদ বর দেহে মিশিতে ইচ্ছিল।।
সর্ব কর্ম ত্যাগ করি প্রভু কতদিন।
গৃহ মাঝে বন্ধ রহে যেন দীনহীন।।
নিকটে যাইতে সবে প্রভু করে মানা।
অন্তরঙ্গ ভক্ত তাহা শুনেও শুনে না।।
বার’শ চুরাশী সাল সে ফাল্গুন মাসে।
বুধবার প্রাতঃকাল তারিখ তেইশে।।
মহাপ্রভু বলে ডেকে ভক্তগণ ঠাই।
“মাহেন্দ্র সুযোগ এল এবে আমি যাই”।।
গঙ্গাচর্ণা নিবাসিনী যমবুড়ী নাম।
ভবানী নামিনী দেবী নড়াইল ধাম।।
রামধন, গোলোক পাগল, মহানন্দ।
উপস্থিত যত ছিল সবে নিরানন্দ।।
কেঁদে কেঁদে সবে বলে মহাপ্রভু ঠাই।
“কি উপায় হবে বাবা! তুমি যবে নাই”।।
প্রভু বলে “শুন, শুন প্রিয় ভক্তগণ।
নিশ্চয় জানিও মোর নাহিক মরণ।।
কায়া ছাড়ি এবে আমি বাহির হইব।
গুরুচাঁদ দেহে গিয়া আপনি মিশিব।।
আমা’ ভাবি গুরুচাঁদে ভকতি করিবে।
গুরুচাঁদ মধ্যে তবে আমাকে দেখিবে।।
যেই গুরুচাঁদ সেই আমি বটে হই।
আমি ছেড়ে কোথা যা’ব গুরুচাঁদে রই”।।
এতবলি মহাপ্রভু কায়া তেয়াগিল।
জ্যোতিঃরূপে গুরুচাঁদ অঙ্গেতে মিশিল।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ অভিন্নাত্মা আত্মা।
পিতাপুত্রে এক দেহে হইল সমতা।।
মানুষে মানুষ মিশে কি মানুষ হ’ল।
হরিগুরুচাঁদ প্রীতে হরি হরি বল।।
*শ্রী শ্রী গুরুচাঁদের গার্হস্থ আশ্রমের নীতি শিক্ষা
ভক্ত সবে সর্বক্ষণে গুরুচাঁদ কয়।
“সর্ব আশ্রমের মূল গৃহাশ্রম হয়।।
যোজন বিস্তৃত শাখা বট বৃক্ষ প্রায়।
বিভিন্ন আশ্রমে ধরি গৃহাশ্রম রয়।।
ব্রহ্মচারী বানপ্রস্থী অথবা সন্ন্যাসী।
গৃহীর আশ্রয় পেতে সবে অভিলাষী।।
গৃহী দেয় অন্নজল গৃহী দেয় অর্থ।
গৃহীর স্বার্থেতে রহে সর্ব জীব স্বার্থ।।
অর্থ ছাড়া বাক্য যথা প্রলাপ বচন।
অর্থ শূন্য গৃহী জনে জানিবে তেমন।।
মহাশক্তি এই অর্থ সবে যাকে চায়।
গৃহীর অর্থেতে দেখ জগত বাঁচায়।।
‘অর্থ অনর্থের মূল’ কহে যেই ভণ্ড,
অর্থর জানে না অর্থ সেই অপগণ্ড।।
এই অর্থ দেখ গৃহী উপার্জন করে।
গৃহীর অর্থেতে তাই বাঁচে সর্ব নরে।।
গার্হস্থ আশ্রম তাই সর্বাশ্রম মূল।
তুলনা মিলে না তার অমূল্য অতুল।।
এই গৃহাশ্রমে যেবা খাঁটি ভাবে রয়।
তাঁর মত মহাসাধু কোথা পাওয়া যায়।।”
মম পিতামহ শ্রীযশোমন্ত ঠাকুর।
লীলা সাঙ্গকালে কথা কহিলা প্রচুর।।
পঞ্চপুত্র কাছে ডাকি সে মহামতি।
শিখা’ল নিগুঢ় মর্ম গৃহধর্ম নীতি।।
পুত্রগণে ডেকে বলে “শুন পুত্রগণ।
জন্মিলে অবশ্য ভবে নিশ্চয় মরণ।।
মোর মনে এই জাগে অল্পকাল পরে।
অবশ্য ত্যজিব দেহ যেতে পরপারে।।
যাত্রার প্রাক্কালে যাহ আমি বলে যাই।
চিরকাল সকলের মনে রাখা চাই।।
পাপ নহে দূরে কোথা পাপ নিজ ঘরে।
নিজ নারী সঙ্গে জীব নিত্য পাপ করে।।
অধিকার আছে ভাবি করে পাপ কর্ম।
নিজ ঘরে নিত্য নরে নাশে গৃহ ধর্ম।।
গৃহস্থ আশ্রম হয় পবিত্র সম্পদ।
পবিত্রতা নষ্ট করি ঘটায় প্রমাদ।।
এজন্য বলিনু সবে থাকিও সামাল।
নারী সঙ্গে বৃথা রঙে হয়োনা পয়মাল।।
একমাত্র এই মূল তত্ত্ব রাখ ঠিক।
এই শিক্ষা আদি শিক্ষা, গৃহীর প্রতীক।।”
মম পিতৃদেব প্রভু শ্রীহরি ঠাকুর।
তিন বাক্য বলে মোরে মধুর মধুর।।
একবাক্যে বলে শিক্ষা দিতে পুত্রগণে।
দ্বিতীয়ে অতন্দ্র থাকি বিজয়ী মরণে।।
তৃতীয় সে আশীর্বাদ কৃপা মম প্রতি।
তিরোভাব কিছু পূর্বে বলিলা সম্প্রতি।।
যশোমন্ত দেব যাহা বলে তাঁর ঠাই।
সেই নীতি পালিবার আজ্ঞা করে সাঁই।।
করজোড়ে নিবেদন করি পিতৃ আগে।
“তব অদর্শনে পিতঃ প্রাণে দ্বন্দ্ব জাগে।।
কি হ’বে করিতে মোর কোন পথে চলি।
দয়া করি পিতা মোরে যাও সব বলি।।”
পিতা ক’ন ‘গুরুচরণ! কি চিন্তা তোমার।
জাগিবে তোমার মনে যা’ কিছু করার।।
মম পিতা যশোমন্ত বলেছেন যাহা।
নিশ্চয় জীবনে তুমি পালিবেক তাহা।।
আমার সাধন ভজন আর কিছু নাই।
পিতৃবাক্য রক্ষা করি তা’তে সব পাই।।
আর শুন বলি কথা ওহে সাধুগণ।
গৃহস্থ আশ্রম নষ্ট কিসের কারণ।।
ব্যভিচার মহাপাপে গৃহাশ্রম নষ্ট।
ব্যভিচার মুক্তি নাই আর লক্ষ্মী ভ্রষ্ট।।
ব্যভিচার বলে কারে শুনিয়াছ তাই।
ঘরে পরে ব্যভিচার আছে সর্ব ঠাই।।
কালাকাল নাহি মানে কাম মুগ্ধ নর।
নিজ নারী লয়ে করে নিত্য ব্যভিচার।।
শুধুই তাহাই নহে ভ্রান্ত নরগণ।
ঘরে পরে করে কত অগম্য গমন।।
এমন হয়েছে দশা দুঃখে মরে যাই।
খুড়ী, মাসী, লঘু, গুরু কিছু
মান্য নাই।।
অজা পশু সম নর ব্যভিচারে মত্ত।
গৃহাশ্রম করে নষ্ট হ’য়ে কামোন্মত্ত।।
অগম্য গমনে হেন যেবা করে পাপ।
তার প্রতি পূর্ব পুরুষের অভিশাপ।।
সাবধান সাধু! সব রহ সাবধান।
ব্যভিচার লক্ষ্মীভ্রষ্ট নষ্ট জাতি মান।।
আপন বাঁচা’য়ে যদি রাখিবারে চাও।
নারীকোল দেও ছেড়ে নিদ্রা নাহি যাও।।
কালের দোসর ঘুম ‘কালনিদ্রা’ কয়।
নিদ্রাকালে হরে ধন রক্ষা নাহি পায়।।
বা’ হাতে খর্পর তা ডান
হাতে খাণ্ডা।
মার মার শব্দে রণে আসে উগ্রচণ্ডা।।
রাত্রিকালে জীবগণ নিদ্রাকোলে ঢলে।
উগ্রচণ্ডা বলি দেয় জীব দলে দলে।।
‘অতন্দ্র’ যে জন রহে নিদ্রা দূর করি।
তাঁর সঙ্গ উগ্রচণ্ডা চলে পরিহরি।।
অবোধ অজ্ঞান নর ইহা নাহি জানে।
নারী, নিদ্রা লোভে পড়ে ডাকে যে মরণে।।
সাধু সাবধান! কহ সাধু সাবধান!
নিদ্রা, নারী পরিহরি সাজ মহাজন।।
সন্তানের সাধ যদি কভু হয় মনে।
ঋতুকালে দিনমাত্র রহ নারী সনে।।
পবিত্র চরিত্র যাঁর নহে ব্যভিচারী।
সন্তান জন্মিতে পারে স্পর্শিলেই নারী।।
ব্যভিচার দোষে যার নহে ঠিক মূল।
অকুল সাগরে ডুবে নাহি পাবে কূল।।
বারে বারে ক্ষণে ক্ষণে এই বাণী কয়।
ব্যভিচারী হ’লে কিন্তু ঘর সারা দায়।।
ফোঁটা হারালে বটে কলসে না কুলায়।
তীর ছেড়ে দিলে হাতে ফিরে কেবা পায়।।
সময় থাকিতে তাই সামাল! সামাল!
ব্যভিচারী হ’লে কিন্তু সব পয়মাল।।
আপন জীবনে প্রভু পালে এই নীতি।
নিদ্রাহীন প্রেমালাপ করে সারারাতি।।
চারি পুত্র এক কন্যা যবে জন্ম লয়।
পাঁচ দিন মাত্র প্রভু নারী সঙ্গে রয়।।
সত্যভামা দেবী লক্ষ্মীমাতা ঠাকুরানী।
জানিয়া পতির মন সাজিলা যোগিনী।।
পবিত্র চরিত্র দোঁহে রহে ভিন্ন ভিন্ন।
এই ব্রতধারী প্রভু গৃহী শিক্ষা জন্য।।
উদার আদর্শ হেন হবে না’ক আর।
গার্হস্থ ধর্মেতে শ্রেষ্ঠ গুরুচাঁদ আমার।।
তাঁর বাণী তাঁর ভাব জীবে লও সুখে।
লইয়া গৃহীর ধর্ম গুরুচাঁদে ডাকে।।
হয় নাই হবে নারে হেন অবতার।
‘হরি গুরুচাঁদ’ সর্ব অবতার সার।।
আদর্শ গৃহস্থ রূপে ‘হরি গুরুরাজ’।
পয়ার প্রবন্ধে কহে কবি রসরাজ।।
No comments:
Post a Comment