পরিশিষ্ট খণ্ডঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ (২য় অংশ)
স্বামী মহানন্দের ভক্তাশ্রমে ভ্রমণ।
পয়ার
বিকালে করিল যাত্রা কুন্দসী হইতে।
দীঘলিয়া আসিলেন সন্ধ্যার পরেতে।।
কেহ কেহ র’ল বেণী পালের আলয়।
যজ্ঞেশ্বর বাটীতে কেহ গিয়া রয়।।
বলাইর ভগ্নী লক্ষ্মী সাধনার শিষ্য।
সেই ঘরে কতক থাকিল হ’য়ে হর্ষ।।
কতক থাকিল ভীম বলাইর বাড়ী।
কতক থাকিল গিয়া গ্রাম আড়াবাড়ী।।
সেই খানে রাত্রিভোর নাম গান গেয়ে।
প্রভাতে করিল যাত্রা শ্রীহরি স্মরিয়ে।।
ঘসিবেড়ে গ্রামে ভাগ্যধর পাল ছিল।
তার বাড়ী কতক আসিয়া উতরিল।।
গোপীনাথ সাহা ছিল মতুয়া প্রেমিক।
ভাগ্যধর গুরু ভাবে বাসে প্রাণাধিক।।
সেই বাড়ী কেহ থাকে কেহ আর বাড়ী।
অষ্টাদশ ঘর পাল সব বাড়ী জুড়ি।।
সব বাড়ী বাড়ী বাল্য সেবা হইতেছে।
সব বাড়ী স্ত্রী পুরুষ নামে মাতিয়াছে।।
মাধ্যাহ্নিক সেবা দিল নামে বাবু রাম।
বিকালে সকলে পহুঁছিল শুক্তা গ্রাম।।
গোলোকচাঁদের বাটী হ’ল মহোৎসব।
সেই বাড়ী মহোৎসব করিতেছে সব।।
শুক্তাগ্রামে গোলোক পালের এক কন্যে।
দিলেন কতক ব্যয় মহোৎসব জন্যে।।
সে বাড়ীতে রাত্রি হ’ল নাম সংকীর্তন।
মহাভাবে মেতে হ’ল নিশি জাগরণ।।
দ্বিপ্রহর রাত্রে সব ভোজন করিল।
রাত্রি ভোর পুনশ্চ কীর্তন আরম্ভিল।।
হইতেছে নর্তন কীর্তন অতিশয়।
প্রেমে মেতে হইয়াছে জ্ঞানশূন্য প্রায়।।
পদ গায় প্রাণ হ’রে নিল নিল নিল।
আসিয়া অক্রুর মুনি প্রাণ হরে নিল।।
রে অক্রুর রথ রাখ হেরি কেলেসোনা।
পায় ধরি পদে পড়ি যত ব্রজাঙ্গনা।।
গান গায় বসে পালেঙ্গার চাক ঘরে।
কেহ চাক ঘুরায় কেহ বা টেনে ধরে।।
বৈশাখে পালের চাক কভু নাহি ঘুরে।
বেড়া হেলানেতে ছিলে ঘরের ভিতরে।।
এক ঠাই ছিল সেই চাক তিনখানা।
কীর্তন সময় দৃষ্টি করে কয় জনা।।
চক্র দেখে হ’ল ব্রজ ভাব উদ্দীপন।
বিস্মিত মূর্ছিত কেহ গায় আর জন।।
চণ্ডী গোস্বামীর পদ গায় কোন জনা।
রাখ রাখ অক্রুর নিওনা কেলেসোনা।।
যখন গায় অক্রুর প্রাণ নিল নিল।
প্রেমাবেশে কেহ কুম্ভ চক্রটি ধরিল।।
চাক দিয়া পাক দিল আলের উপরে।
রাখ রাখ বলি কেহ চাক টেনে ধরে।।
তাহা দেখি ঘূর্ণপাক পাগল ধরিল।
নিওনা বলিয়া চাকে মাথা পেতে দিল।।
মাথায় তুলিল চাক প্রেমেতে বিহ্বল।
অষ্টধারে বহিল যুগল চক্ষে জল।।
সে চাক চতুঃপার্শ্বে মস্তকে রাখিয়ে।
ঘুরাতে লাগিল চাক জড়াজড়ি হ’য়ে।।
এইরূপে ধরিলেন আর দুই চাক।
সবে বলে ওরে রথী রথ রাখ রাখ।।
হা কৃষ্ণ বলিয়া কেহ পড়িল ধরায়।
মূর্ছিত হইল কেহ চাকের নীচায়।।
পাগলের শির গিয়া ঠেকিয়াছে চাকে।
মাটি দিয়া ধুমা উঠে দেখে সব লোকে।।
তাহা দেখি সব লোক পড়িল হুতাশে।
চমকিত হ’য়ে বলে ধুমা উঠে কিসে।।
চাকা ধরি পালেরা লইল পালেঙ্গায়।
মূর্ছাপ্রাপ্ত যারা তাহাদের ধরে লয়।।
সবে দেখে পাগল পড়িয়া ধরণীতে।
ধুম্র উঠিতেছে পাগলের অঙ্গ হ’তে।।
বাড়ীপরে পালেঙ্গা পশ্চিমের পোতায়।
সেই ঘরে যাদব পাগলে ধরি লয়।।
সনাতন নবীন বসু ছিলেন তথায়।
তাহারা পাগলে ধরিলেন সে সময়।।
ধুমা কেন উঠিতেছে পাগলের গায়।
দাহ হ’য়ে পাছে বা পাগল মারা যায়।।
তোরা সব থাকরে উপায় আর নাই।
দক্ষিণ পালেঙ্গাতে পাগলে ল’য়ে যাই।।
পাগলে তদ্রূপ দেখি সবার হুতাশ।
সেই ঘরে ল’য়ে যেতে করি অভিলাষ।।
এতশুনি সর্বজনে পাগলে তুলিল।
দক্ষিণ পালেঙ্গা ঘরে ধরিয়া লইল।।
অনর্গল ধুমা উঠে পাগলের গায়।
লোমকূপে ধুমা উঠে ছিদ্র কণ্ডু প্রায়।।
লোমকূপে ছিদ্র সব বিকশিত হ’য়ে।
ধুমা উঠিতেছে শূন্যে বেগেতে ধাইয়ে।।
ক্ষণে ধুমা উঠে হয় অন্ধকারময়।
ক্ষণে পাগলের অঙ্গ লক্ষ্য নাহি হয়।।
লোম উর্দ্ধ কেশ উর্দ্ধ নেত্র উর্দ্ধ শ্বাস।
ন ভূত, ন ভবিষ্যতি, ভাব অপ্রকাশ।।
মুখমধ্যে রক্তিম বরণ যায় দেখা।
মুখের উপরে উঠে অনলের শিখা।।
ঘরের মধ্যেতে আর ঘরের চৌদিকে।
হরি হরি হরি বলে নাচে গায় লোকে।।
পাগল বৈবর্ণ অঙ্গ ধুম্র সম্বরিল।
আস্তে ব্যাস্তে ত্রস্তে পাগলেরে কোলে নিল।।
তৈল মেখে পাগলেরে করাইল স্নান।
করা হ’ল সকলের সেবার বিধান।।
যবে পাগলের হ’ল সম্বিত বিধান।
সবে মৃতদেহে যেন পুনঃ পেল প্রাণ।।
প্রেমময় পাগলের অলৌকিক কাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
পাগলের চাপলিয়া গ্রামে যাত্রা।
পয়ার
নামেতে কাঙ্গালী পাল সাধু শুদ্ধ মতি।
চিরদিন শুক্তাগ্রামে করেন বসতি।।
বিকালে তাহার বাটী হ’ল মহোৎসব।
রহিলেন সেই বাড়ী মতুয়ারা সব।।
সেই বেলা ভরি হ’ল নাম সংকীর্তন।
অর্ধ নিশি পর্যন্ত নাহিক নিবারণ।।
সবে ক্ষান্ত প্রেম শান্ত সংকীর্তন সায়।
সব সাধু ভোজন হইল সে সময়।।
প্রাতেঃ উঠি চলিলেন চাপলিয়া গ্রাম।
সেই গ্রামে সাধু অতি শুকচাঁদ নাম।।
সেই বাড়ী যাত্রা কৈল নাম প্রেমাবেশে।
মতুয়ারা মাতোয়ারা নাচে কাঁদে হাসে।।
সেই শুক্রাগ্রামে একজন দ্বিজ ছিল।
সংকীর্তনকালে বড় তর্ক আরম্ভিল।।
পাগল ছিলেন বসি পালেঙ্গার ঘরে।
শ্রীনবীন বসু গিয়া কহে পাগলেরে।।
এক বেটা ব্রাহ্মণ এসেছে এ বাটীতে।
কুতর্ক করেছে সেই কীর্তন স্থানেতে।।
তাহা শুনি পাগল হইল ধাবমান।
সংকীর্তন মাঝে স্বামী মহানন্দ যান।।
অমনি বহিল বন্যা কীর্তন প্রাঙ্গণে।
ঝঞ্ঝাবাত যেমন বহিল রম্ভাবনে।।
যে স্থলে যে ছিল কারু আর বাক্য নাই।
হরি বলে গড়াগড়ি দিতেছে সবাই।।
সেই বিপ্র হ’য়ে ক্ষিপ্র গড়াগড়ি যায়।
উন্মত্ত হইয়া পড়ে পাগলের পায়।।
পাগলে আগুলে দ্বিজ রাখিতে না পারে।
জড়াইয়া ধরিলেন অক্ষয় ঠাকুরে।।
দুই দ্বিজ জড়াজড়ি গড়াগড়ি যায়।
দৌড় দিয়া কীর্তন ছাড়িয়া বাহিরায়।।
কদর্য উচ্ছিষ্ট স্থান নামেতে আদাড়।
গড়াগড়ি যায় বিপ্র তাহার উপর।।
সেই কথা পথে এসে হ’ল আন্দোলন।
কি মাহাত্ম্য পাগলের চরণে ব্রাহ্মণ।।
মদন বিশ্বাস পূর্ণচন্দ্র অধিকারী।
দোঁহে করে আন্দোলন ন্যায় পথ ধরি।।
আগে করে কুতর্ক জাতির কথা কয়।
সে জাতিতে এসে শেষে চরণে লোটায়।।
তারক বলিল অই দেমাকী ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণ রূপেতে ওরা শুক্রাচার্যগণ।।
গ্রন্থে বলে চাঁদকাজী নোয়াইল মাথা।
এত হিন্দু ব্রাহ্মণ লুকা’য়ে যা’বে কোথা।।
বলিতে বলিতে প্রেম আবেশ তখন।
গান ধরি দিল কোথা পালাবি যবন।।
শ্রীগৌরাঙ্গ এল সেজে আয় কাজী আয়।
কা’ল ভেঙ্গেছি খোল আজ
যাবি কোথায়।।
সবে মিলে গায় বোল অঙ্গে উঠে কম্প।
কোথা যাবি বলিয়া কেহ বা মারে লম্ফ।।
কেহ কেহ বীর দর্প যষ্ঠি ঘুরাইয়া।
কেহ করে বীরদর্প যষ্ঠি দেখাইয়া।।
বাবরা গ্রামেতে যত বসতি যবন।
অই রূপ ভাব তারা করি দরশন।।
বাড়ীর বাহিরে মাঠে ঘাটে ছিল যারা।
বাড়ীর মধ্যেতে গিয়া পলাইল তারা।।
তিন মিয়া এসে ধেয়ে আগুলিল পথে।
সবিনয় বলে মোর বাড়ী হবে যেতে।।
মতুয়ারা বলে যদি বল হরিবোল।
তবে তোমাদের বাড়ী যাইব সকল।।
তাহা শুনি তিন মিয়া বলে হরিবোল।
দৌড়ে গিয়া পাগল তাদের দিল কোল।।
পাগলে লইয়া গেল বাড়ীর ভিতর।
পাড়ার মিয়ারা যত হ’ল একত্তর।।
বাড়ীর উপরে গিয়া ঘুরিছে পাগল।
তাহা দেখি মিয়ারা বলিছে হরিবোল।।
তাহা দেখি মতুয়ারা সেইভাবে মেতে।
হরি বলে নাচিতে লাগিল নানা মতে।।
লাফাইয়া উঠিলেন বাড়ীর উপর।
মতুয়ারা মিয়ারা হইল একতর।।
বিবি সাহেবেরা সবে এল দেখিবারে।
তাহারাও সঙ্গে সঙ্গে হরিনাম করে।।
কে কারে কি করে কেহ বুঝিতে না পারে।
বড় ভীড় গোলমাল বাড়ীর উপরে।।
হাঁক দিয়া পাগল আইলেন বাহিরে।
জয় হরি গৌরহরি বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
শেষে আর যত সাধু বাড়ীপরে ছিল।
কিছুক্ষণ পরে সবে বাহির হইল।।
একতর মতুয়ারা হইল সকল।
শুনিতেছে মিয়া বাড়ী হরি হরি বোল।।
কিছুকাল পরে তাহা হ’ল সম্বরণ।
পুনরায় মতুয়ারা জুড়িল কীর্তন।।
গীত
আমার গৌরাঙ্গ এল সেজে আয়রে কাজী আয়
কাজী আয় কাজী আয় কাজী আয় কাজী আয়
কা’ল ভেঙ্গেছিস খোল
করতাল
আইজ যাবি কোথায়।।
আমরা ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব মানিনে
তুই লাগিস কোথায়।।
পয়ার
গাইতে গাইতে পদ যায় চাপলিয়ে।
জ্ঞান হয় যেন যায় ভূমিকম্প হ’য়ে।।
চাপলিয়া গ্রামবাসী যত লোক ছিল।
শুকচাঁদ মণ্ডলের বাড়ীতে আসিল।।
স্ত্রী পুরুষ বাল্য বৃদ্ধ বারো আনা প্রায়।
গ্রামের যতেক হিন্দু আইল তথায়।।
এ দিকে মতুয়া চলে দুই ভাগ হ’য়ে।
এক ভাগ বাড়ীপর উঠিলেন গিয়ে।।
বাড়ীর উপরে গিয়া বলে হরি বোল।
প্রেমানন্দে মহানন্দ নাচিছে কেবল।।
মতুয়ারা যত ছিল বাড়ীর উপরে।
তাদের পাগল বলে তাড়া উহাদেরে।।
বাড়ীর নীচায় যারা করে হই হই।
উঠিতে পারে না যেন সবাকারে কই।।
গ্রামবাসী যারা বাড়ী পরে হরি বলে।
সবলোকে মহানন্দ তাড়াইয়া দিলে।।
হাঁড়ি কাঁধা ইটা চেঙ্গা আনিয়া সত্বর।
বলে তোরা ইহাদিকে ইহা ফেলে মা’র।।
কোনমতে ইহাদিকে উঠিতে না দিবি।
ওরা যদি বাড়ী ওঠে তোরা মা’র খাবি।।
পূর্ণচন্দ্র অধিকারী উঠিল অগ্রেতে।
দুই চারি ঢিলা ঘায় নামিল নিম্নেতে।।
পাগল কহিছে না উঠিস বাড়ীপর।
কি করিবি তোদেরে বা কেটা করে ডর।।
প্রাণ ভয় থাকে যদি প্রাণ লয়ে পালা।
এদেশেতে খাটিবে না হই হই বলা।।
চন্দ্রকান্ত মল্লিক সে পদুমা নিবাসী।
বাড়ীর নিকটে সেও উত্তরিল আসি।।
সে পূর্ণ অধিকারীর করেতে ধরিয়া।
বাড়ীর উপরে পড়ে এক লম্ফ দিয়া।।
ত্রেতা যুগ হ’তে যেন আইল বানর।
তেমনি লাফিয়া পড়ে বাড়ীর ভিতর।।
শ্রীহরিপাল তারক অক্ষয় ঠাকুর।
বাড়ী প’রে বলে নেড়ে যাবি কতদূর।।
মারামারি দেখি মার খাইতে এলাম।
মরি যদি ফিরিব না দিব হরিনাম।।
ঘরে পরে করে ধ’রে হরিনাম দিব।
শ্রীহরিচাঁদের প্রেম ফিরায়ে কি নিব।।
ঝাঁকে পড়ে কাঁধা চাড়া চেঙ্গা আর ইট।
মার মার বলিয়া পাতিয়া দিল পিঠ।।
দুই দিকে নাচিছে পাগল মহানন্দ।
মার মার মার বলি পরম আনন্দ।।
বাড়ীর উপরে এল মার মার মার।
ভয় নাই যারে পাই তারে ধরি মার।।
মার মার কোথাকার ছার হরিবোলা।
হরিবোলা মারিয়া হ’বরে হরিবোলা।।
হরিবোলারা উঠিল বাড়ীর উপর।
মেশামেশি দুই দলে হ’ল একত্তর।।
আর মারামারি নাই নাই গণ্ডগোল।
এ দলে ও দলে মিলে বলে হরিবোল।।
যাদব মল্লিক বলে জয় জয় জয়।
হরিচাঁদ জয় শ্রীগোলোকচাঁদ জয়।।
গুরুচাঁদ জয় জয় জয় হীরামন।
জয় জয় হরিচাঁদ পতিত পাবন।।
জয় জয় দশরথ ভক্তগণ জয়।
জয় যত হরিবোলা জয় মৃত্যুঞ্জয়।।
হরি বলে পড়ে ঢলে যাদব মল্লিক।
মতুয়ারা মাতোয়ারা নাই দিগ্বিদিক।।
কোলাকুলি ঢলাঢলি প্রেম আলিঙ্গন।
কেহ কেহ যায় মোহ ধুলায় পতন।।
ধুলায় ধূসর কেহ যায় গড়াগড়ি।
লম্ফ ঝম্ফ গাত্র কম্প প্রেমে হুড়াহুড়ি।।
চন্দ্রকান্ত মল্লিক পড়িয়া ভূমিতলে।
পাগলের পদ ধরি হরি হরি বলে।।
সংকীর্তন মধ্য হ’তে পাগল উঠিল।
লম্ফ দিয়া পশ্চিমের ঘরে প্রবেশিল।।
শান্ত নামে এক কন্যা মত্তা হরিনামে।
সতী সাধ্বী সুচরিত্রা শুদ্ধা ভক্তি প্রেমে।।
পাগলের প্রতি তার দৃঢ় ভক্তি রয়।
চারি ভাই তাহাদের নির্মল হৃদয়।।
নিবারণ শীতল কার্ত্তিক রতিকান্ত।
সাধু মহাজন প্রতি ভকতি একান্ত।।
তারকের শিষ্যপুত্রী সুমতী শ্রীমতী।
পাগলকে ধরিলেন সেই গুণবতী।।
শুকচাঁদ কানাই নিমায় কয় ভাই।
নাচিছে কীর্তনে আনন্দের সীমা নাই।।
তাহাদের ভগ্নী ধনী বসন্ত নামিনী।
হরি বলে পাগলে ধরিল সেই ধনী।।
পাগল তখনে দুই বাহু প্রসারিয়া।
সেই দুই মেয়েকে ধরিল সাপুটিয়া।।
অজ্ঞান হইয়া দোঁহে ঢলিয়া পড়িল।
যেন ভাদ্রে বান ডেকে ভাসাইয়া নিল।।
পূর্ণ অধিকারী হরিপাল পড়ে তথি।
মূর্ছা প্রাপ্তে পড়িল অক্ষয় চক্রবর্তী।।
কে কারে কি করে পড়ে কেবা কার গায়।
কি সুখ বাড়িল শুকচাঁদের আলয়।।
মদন বিশ্বাস এক পদ ধরি এল।
নিল প্রাণ নিলরে গৌরাঙ্গরূপে নিল।।
গৌরাঙ্গ দাঁড়ায়ে অই সুরধনী কূলে।
চল গো সজনী চল যাই গো সকলে।।
জল আনা ছল করি চল ন’দে বাসী।
জল আনা ছলেতে গৌরাঙ্গ দেখে আসি।।
এতেক বলিয়া কক্ষে লইল কলসী।
চল গিয়া গৌরাঙ্গ চরণে হই দাসী।।
সবে মিলে হ’ল যেন উন্মত্ত পাগল।
নর নারী বাল্য বৃদ্ধ বলে হরি বোল।।
কেহ কেহ উঠে গিয়া বসিল গৃহেতে।
কেহ নৃত্য করে অন্তঃপুর প্রাঙ্গণেতে।।
প্রেমাবেশে বাল্য বৃদ্ধ যুবা নর নারী।
সবে মিলে অম্লান অন্তরে ধরাধরি।।
স্ত্রী পুরুষ ধাবমান হ’ল একত্রেতে।
এক এক জন পাত্র লইল কক্ষেতে।।
কেহ ধায় এলোকেশে কেহ ঘোমটা টানে।
পুরুষে ঘোমটা দেয় কোঁচার বসনে।।
দুপুরের মধ্যেতে কেহ হ’তে নারে স্থির।
বাহির বাটীতে সব হইল বাহির।।
মতুয়ারা রামাগণে ধরিয়া ধরিয়া।
বাড়ীর উপরে সবে রাখে ঠেকাইয়া।।
কতক মতুয়াগণ বাড়ীদিকে ধায়।
নিবারণ শীতলের বাটীতে উদয়।।
কেহ কয় গঙ্গাতীরে উদয় অরুণ।
কেহ কয় অরুণের চরণে বরুণ।।
কেহ কয় তবে জল নিতে হ’ল ভাল।
গৌরাঙ্গ অরুণ পদে বরুণ পড়িল।।
তরুণ অরুণ সঙ্গে চন্দ্র যোগাযোগ।
কেহ বলে এই সেই পুস্পবন্ত যোগ।।
কেহ বলে তার মধ্যে গঙ্গা সুরধনী।
কেহ বলে এই যোগ যোগ চূড়ামণি।।
কেহ বলে ভাসিয়া গেলাম অশ্রুজলে।
কেহ বলে দেখা কি পাইব গঙ্গাকূলে।।
কেহ বলে নাহি পেলে জাহ্নবীর কূলে।
কেহ বলে তবে দাসী হইবি কি ছলে।।
কেহ কেহ তুলে নিজ কক্ষেতে কলসী।
কেহ বলে হইব গৌরাঙ্গপদে দাসী।।
কেহ পিত্তলিয়া কুম্ভ করিয়াছে কক্ষে।
কেহ নাচে মেটে কুম্ভ ক্ষপরে রেখে।।
কেহ বাহিরের কুম্ভ পূর্ণ কিংবা খালি।
কেহ তার একটা লইল কক্ষে তুলি।।
কেহ বলে ক্ষান্ত না করিও সংকীর্তন।
কেহ বলে ধর ওই গৌরাঙ্গ চরণ।।
কেহ নাচিয়া গাইয়া চলেছে কাঁদিয়া।
কেহ কার গায় পড়ে হেলিয়া দুলিয়া।।
কেহ যায় স্নানে কালীগঙ্গা মরানদী।
কেহ সেই ঘাটে গিয়া করে কাঁদাকাঁদি।।
কেহ কেহ বলিতে সকলে ঘাটে গেল।
কেহ বলে কে গো এই বর্ণ যেন কালো।।
কেহ বলে গোরা ছবি প্রাতঃ রবি প্রায়।
কেহ বলে কালশশী তাতে মিশি রয়।।
কেহ বলে কাল গৌর মাঝেতে দাঁড়ায়।
কেহ কেহ বলে অই বাঁশী করে লয়।।
কেহ বলে কাল গোরারূপ জলের ছায়ায়।
কনক কমল কাল কমলে উদয়।।
কাল জলে কাল জ্বলে দেখ গো কেমন।
নিলাজ হেমাব্জ মাঝে হ’য়েছে মিলন।।
জলে জ্বলে জলদধ দেখে সখীগণ।
জলে যাই হেরি রাই শ্যামের মিলন।।
একা আমি আমি তোরা না নামিস কেউ।
দেখ রূপ জ্বলে জলে দিওনা লো ঢেউ।।
একা আমি ধরে আমি শ্যাম জলধর।
নামিলে হারাবি জলে পাবি না অধর।।
আমি ধরি বলে জলে নামিল
সকল।
বলে কই রাই কই সে নীলকমল।।
জলে নামি করে সবে শ্যাম অন্বেষণ।
ডুব দিয়া মহানন্দে করে দরশন।।
কেহ বলে রাই শ্যাম করে জলকেলি।
জলে নামি করে সবে জল ফেলাফেলি।।
কেহ বলে গঙ্গাজল সেচে দিব ফেলে।
জলধর লুকায়েছে কালীগঙ্গা জলে।।
কেহ বলে আর কত কাঁদিবি আকুলে।
কেহ বলে জলে জ্বলে চল যাই কূলে।।
কেহ বলে কুল গেল বিরজার কুলে।
কেহ বলে কুল কালা কাজ কি গো কুলে।।
কেহ বলে কুলে জ্বেলে দিয়াছি অনল।
কেহ বলে জল ঢেলে কর গো শীতল।।
কেহ বলে ভাসা কুল কুলে দিয়া জল।
কেহ বলে কুল সাথে যা’বে কার বল।।
কেহ বলে কুল ধুয়ে খাবি নাকি জল।
কেহ বলে কুল যাক কূলে যাই চল।।
এতেক বলিয়া সবে চলিলেন বেগে।
হরিপাল অক্ষয় ঠাকুর চলে আগে।।
জয় হরিধ্বনি করে যত রামাগণে।
তীরে এসে হুলুধ্বনি দিল সর্বজনে।।
চন্দ্রকান্ত মল্লিক ধেয়েছে পাছে পাছে।
গাছবাড়িয়ার রামধন চন্দ্র নাচে।।
মদন বিশ্বাস বলে চল চুপে চুপে।
টের পেলে গুরুজন উঠিবেন ক্ষেপে।।
এরূপেতে অপরূপ প্রেমের তরঙ্গ।
পাগল সাঁতারে প্রেম সংকীর্তন ভঙ্গ।।
স্বাভাবিক ভাবে সুস্থ হইলেন সব।
নিবারণ বাটী হ’ল চিঁড়া মহোৎসব।।
অন্নভোজ করে সবে শুকচাঁদ বাড়ী।
পাগলে ধরিল শুকচাঁদের মা বুড়ি।।
অক্ষয় ঠাকুর আর পাগলকে ল’য়ে।
দুজনকে ভুঞ্জাইল কোলে বসাইয়ে।।
পশ্চিমের ঘরে সবে বসিয়া নিভৃতে।
তারকে ডাকিয়া আনাইল নিকটেতে।।
অক্ষয় ঠাকুরে করাইতে উপদিষ্ট।
বলিলেন তারকেরে তুমি হও ইষ্ট।।
তারক কহেন ইহা আমি নাহি পারি।
উপদিষ্ট হউন ব্রাহ্মণ এক ধরি।।
অক্ষয় কাঁদিয়া কহে ব্রাহ্মণে কি কাজ।
অংশ অবতার তুমি ইষ্ট দ্বিজরাজ।।
আমি যার পিপাসিত তাই যদি পাই।
যার ঠাই পাই তাই নিব তার ঠাই।।
মোর প্রশ্নোত্তর দেন সব মহারথী।
গুরু কোন জাতি হয় মন্ত্র কোন জাতি।।
শুকদেব হাঁড়ির নিকটে মন্ত্র নিল।
শুকপাখী ছানা তবু বিপ্র আখ্যা পেল।।
পাগল তারকে কহে হরি সহকারী।
পারিবা না এই কার্য যদি আজ্ঞা করি।।
পাগল কহেন আজ্ঞা দিলাম তোমায়।
তারক কহিল অসম্ভব কিছু নয়।।
কর্ণমূলে মহামন্ত্র করিলেন দান।
পাইয়া চিন্ময়ী শক্তি হ’ল শক্তিমান।।
প্রেমানন্দে ঢলাঢলি হইল সকল।
জয়ধ্বনি করি সবে বলে হরিবোল।।
স্বীয় স্বীয় স্থানে সব গমন করিল।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত তারক রচিল।।
No comments:
Post a Comment