মতুয়াদের সামাজিক বিঁধি ও কিছু কথা-৩
মৃতদেহের সৎকার ও তৎপরবর্তী সংস্কার
গত পর্বে আমি কবি রসরাজ শ্রীমৎ তারক চন্দ্র সরকার প্রণীত “শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত” এর সাহায্যে মৃতদেহের সৎকার ও তৎপরবর্তী সংস্কার বিষয়ে লিখেছিলাম। এই পর্বে কর্মবীর বিচরণ পাগল বিরচিত “শ্রী শ্রী হরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা” এর আলোকে একই বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চেষ্টা করব।
শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর দেহ রাখার পর কিভাবে সৎকার করা হয়েছিল তার কোন বিস্তারিত বর্ণনা নেই। তবে ‘গুরুচাঁদ দেহে শ্রীহরিচাঁদের সম্মিলন’ এই পরিচ্ছেদে প্রভুর অঙ্গ সৎকারের কথা বলা হয়েছে।“হরিচাঁদ মিশিয়াছে গুরুচাঁদ সনে। প্রভু অঙ্গ সৎকার করে সর্বজনে।।”
গুরুচাঁদ ঠাকুর স্বয়ং কয়েকটি এরকম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যেমন ‘মহাত্মা গুরুচরণ বালার মানব লীলাসম্বরণ’ ও ‘তস্য শ্রাদ্ধ্য উপলক্ষে মহোৎসব ও গুরুচাঁদের আগমন’ পরিচ্ছদদ্বয়ে বলা হচ্ছে“অপরেতে গ্রামবাসী আসিয়ে সকলে। দাহকার্য করে সবে হরি হরি বলে।।”এবং“করে আয়োজন, মিলি বহুজন, শ্রাদ্ধাদি হইল শেষ। ভক্তবৃন্দ সঙ্গে, অতি মনরঙ্গে, উদিলেন জগদীশ।।মহোৎসব পূর্বদিনে, প্রভু এল এ ভবনে, কতিপয় ভক্ত সঙ্গে রয়।”এখানে শ্রাদ্ধ্য শেষে মহোৎসবের উল্লেখ আছে। কিন্তু শ্রাদ্ধ্য বাদ দিয়ে শুধু মহোৎসবের কথা বলা হয়নি।
‘স্বামী মহানন্দ পাগলের লীলা সাঙ্গ’ পরিচ্ছেদেও দেহ সৎকারের কথা বলা হয়েছে, তবে কিভাবে করা হয়েছে তার বর্ণনা নেই। “সবে মিলি স্বামীদেহ করেন সৎকার। দীননাথ কেঁদে ফেরে করি হাহাকার।।”
মহেশ ব্যাপারীর শ্রাদ্ধ্য উপলক্ষ্যে আয়োজিত মহোৎসবেও গুরুচাঁদ ঠাকুর স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। ‘মহেশ ব্যাপারীর মানবলীলা সম্বরান্তে মহোৎসব’ পরিচ্ছেদে বলা হচ্ছে,“শ্রাদ্ধ্য উপলক্ষ্যে তথা মহোৎসব হয়। বংশধরগণে সবে প্রফুল্ল হৃদয়।।আসিলেন গুরুচাঁদ এ মহোৎসবে। চারিদিক হ’তে এল ম’তোগণ সবে।।”
এবার আসি ওঢ়াকাঁদি ঠাকুর বাড়িতে যেসব মৃতদেহের সৎকার হয়েছিল গুরুচাঁদ ঠাকুর বর্তমান অবস্থায় তার আলোচনায়। প্রথমে ‘শ্রীযুক্ত শশিভূষণ ঠাকুরের বিয়োগ’ ‘শোক উচ্ছাস’ অংশে উক্ত হয়েছে,“আকুল হইয়া কাঁদে, হিয়ে ধৈর্য নাহি বাধে, দশদিন এভাবে কাটিল।একাদশ দিনে পরে, বিধিমত শ্রাদ্ধ্য করে, সমাজের ভাবে সব হ’ল।”এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে তৎকালীন সমাজে যেরকম বিধি প্রচলন ছিল (যা বর্তমানেও প্রচলিত) সেভাবেই ঠাকুর বাড়িতে এই সংস্কার পালিত হয়েছে। দশদিন পরে একাদশ দিনে শ্রাদ্ধ্য করেছিল।
‘শ্রীশ্রীসুধন্য ঠাকুরের রমণীর বিয়োগ’ অংশে সমাজে প্রচলিতভাবেই শ্রাদ্ধ্যের কথা উক্ত হয়েছে। এবং প্রচলিত বেদক্রিয়া বা বৈদিকক্রিয়া করার কথা বলা হয়েছে। “একাদশ দিন পরে বেদক্রিয়া সারি। ক্রমে শান্ত হয় সবে শোক পরিহারি।।”
ঠাকুর বাড়িতে মৃতদেহের সৎকারের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয় মাতা সত্যভামা দেবী মারা যাওয়ার পর। মাতার দশার (শ্রাদ্ধ্য) দিনে প্রধান প্রধান মতুয়াসহ বহু মতুয়ার আগমন হয়। ‘মাতা সত্যভামাদেবীর মানবলীলা সম্বরণ’ পরিচ্ছেদের উক্তি “দশাহা দিনেতে এল বহু মতোগণ। প্রধান প্রধান ম’তো ছিল যতজন।।”
সেই অনুষ্ঠানে মাথা কেশ ফেলা নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং এটা নিয়ে গুরুচাঁদের কাছে যাওয়া হয়। গুরুচাঁদ মাথার চুল কেটে ফেলা বা ছোলার পক্ষেই মত দেন। এবং তার কথাঅনুসারে অনেক ভক্তগণ সেদিন পুত্রোচিত ভাবে মাতার সৎকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। যেমন বলা হচ্ছে,“এইভাবে বহুক্ষণ অতীত হইল। হেনকালে এক কথা প্রস্তাব করিল।।আমাদের মাথে আছে অতি দীর্ঘ কেশ। এবে মোরা রাখিবারে নাহি এই বেশ।।কেহ ভালো কেহ মন্দ বলিতে লাগিল। প্রভুর নিকটে গিয়ে সবে জানাইল।।মহাপ্রভু সেই বাক্যে সম্মত হইল। পুত্রোচিত ব্যবহার সকলে করিল।। বিধিমতে বেদক্রিয়া সকলে করিয়ে। শ্রাদ্ধ্যাদি করিল সবে হরিধ্বনি দিয়ে।।
এবং বিধিমতে বেদক্রিয়া করে শ্রাদ্ধ্যক্রিয়া সম্পাদন করে। এবং এরপর বড় আকারে মহোৎসবের আয়োজন করা হয়। তৎকালীন সময়ের ৮৩ মণ চাল ওই অনুষ্ঠানে ব্যায়ের কথা বলা হয়েছে। “মহোৎসব আয়োজন বিপুল ভাবেতে। কত কি আসিল দ্রব্য কে পারে বর্ণিতে।।” এবং “এইভাবে মহোৎসব হ’ল সমাপন। চা’ল ব্যয় হল তাহে তিরআশি মণ।।”
তাহলে শ্রী শ্রী হরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধার আলোকে বলা যায়। মৃতদেহের সৎকার সমাজে প্রচলিতভাবে হত এবং বর্তমানে জ্ঞাতিভোজ অনুষ্ঠানের পরিবর্তে মহোৎসব অনুষ্ঠান করা হত। মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা বা মাটিতে পুঁতে রাখা বা নদীর জলে বিসর্জনের কোন বিরোধিতা করা হয়নি।
হয়ত সূক্ষ্মতত্ত্ব আমি বুঝতে পারি নাই। হয়ত অযথা প্রলাপ বকলাম। তবে বর্তমানের এই বিভেদ দূর করতে “শ্রী শ্রী হরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা” এর দেখান পথে হাটা যেতে পারে। সমাজে প্রচলিতভাবে সৎকারের পর জ্ঞাতিভোজ অনুষ্ঠানের পরিবর্তে মহোৎসব করা যেতে পারে।
হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল।
Social Counter
Comments