শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.
২ আদিখণ্ডঃ চতুর্থ তরঙ্গ - মতুয়ার বার্তা

শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.

  • Breaking News

    হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা

    ➤ ১. সদা সত্য কথা বলবে। ➤ ২. পিতা-মাতাকে দেবজ্ঞানে ভক্তি করবে।➤ ৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে। ➤ ৪. জগতকে ভালোবাসবে।➤ ৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে। ➤ ৬. জাতিভেদ করবে না। ➤ ৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। ➤ ৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে। ➤ ৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে। ➤ ১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না। ➤ ১১. ষড়রিপু বশে রাখবে। ➤ ১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।

    ২ আদিখণ্ডঃ চতুর্থ তরঙ্গ


                            আদিখণ্ডঃ চতুর্থ তরঙ্গ

    আদিখণ্ড
    চতুর্থ তরঙ্গ
    বন্দনা
    জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
    জয় শ্রীবৈষ্ণব দাস জয় গৌরী-দাস।।
    জয় শ্রীস্বরূপদাস পঞ্চ সহোদর।
    পতিতপাবন হেতু হৈলা অবতার।।
    জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
    জয় শ্রীগোলোকচন্দ্র জয় শ্রীলোচন।।
    জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়

    জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দ ময়
    ।।
    জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
    নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ
    ।।

    গ্রন্থকারের প্রতি গ্রন্থ লিখিবার আদেশ
    পয়ার
    মৃত্যুঞ্জয় দশরথ এই দুইজনা

    বলিলেন লীলামৃত করিতে রচনা
    ।।
    প্রভূর এ শেষ লীলা প্রেমভক্তি দান

    রচনা করহ শীঘ্র লীলার প্রধান
    ।।
    চরণ ধরিয়া তবে বলিল তারক

    স্বীকার করিনু আমি তোমার সেবক
    ।।
    অতিদীন অভাজন আমি মূঢ়মতি

    এ লীলা বর্ণিতে মম না হবে শকতি
    ।।
    একে আমি দীনহীন অক্ষম জঘন্য

    আমার এ লেখা ভবে কে করিবে মান্য
    ।।
    দুই প্রভ বলে হরিচাঁদে রেখে ভক্তি

    লিখিতে আরম্ভ কর হবে তোর শক্তি
    ।।
    বিশ্বাস না করিস মোদের কথা ধর

    লিখিতে পারিবি গ্রন্থ তোরে দিনু বর
    ।।
    মৃত্যুঞ্জয় বলে তুমি শুন মোর সোনা

    উপাধি দিয়াছি তোরে তারক রসনা
    ।।
    দশরথ বলে বাক্য লঙ্ঘিও না আর

    মৃত্যুঞ্জয় দিল বর আমার সে বর
    ।।
    আমার রচিত গান আছে তোর শুনা

    তাতে পদ গাঁথা আছে তারক-রসনা
    ।।
    নিচ জন বলে ভেবে হইলি ব্যাকুল

    কাঁদা জল বিনে কোথা ফুটে পদ্ম ফুল
    ।।
    মুনি হৈল বিশ্বামিত্র গাধির নন্দন

    মেনকার সঙ্গে তার হইল মিলন
    ।।
    তাতে জন্মে কন্যা শকুন্তলা নাম ধরে

    কুরুপান্ডবের আদি ব্যক্ত এ সংসারে
    ।।
    হরিনীর গর্ভে জন্মে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি

    যার যজ্ঞে চরু জন্মে রামায়ণে শুনি
    ।।
    লোমপাদ রাজার রাজ্যে অনাবৃষ্টি ছিল

    মুনি আগমনে শেষে ইন্দ্র বরষিল
    ।।
    অযোধ্যায় এসে সেই মুনি যজ্ঞ করে

    চরু খেয়ে তিন রাজরাণী গর্ভ ধরে
    ।।
    সেই গর্ভে হইলেন রাম অবতার

    যথা তথা জন্ম কিন্তু কর্ম ধর সার
    ।।
    ব্রহ্মার ঔরষে তিলোত্তমার উদরে

    বেশ্যাপুত্র বশিষ্ঠ সে ব্যক্ত চরাচরে
    ।।
    যোগ-বশিষ্ঠ রামায়ণ যোগে বসি করে

    ব্যাস মুনি জন্মে মৎস্যগন্ধার উদরে
    ।।
    চারি বেদ চৌদ্দ শাস্ত্র আঠার পুরাণ

    বেদব্যাসকৃত জীব বাসনা পুরাণ
    ।।
    কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছে আপনি

    শক্ত্যাবেশ অবতার পৃথু ব্যাস মুনি
    ।।
    তোর কেন ভয় হল করিতে রচনা

    তোর জন্য তপস্যা করিব দুই জনা
    ।।
    যার কর্ম সেই করাইবে তোরে দিয়া

    রচনা করহ গ্রন্থ তাহারে ভাবিয়া
    ।।
    এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল

    পারিব না ভেবে গ্রন্থ লেখা নাহি হ
    ।।
    একদিন দৈব যোগে নিশি অবসানে

    গোঁসাই গোলক এসে দেখায় স্বপনে
    ।।
    নর হরি রূপ ধরি বুকে হাটু দিয়া

    বক্ষঃস্থলে দিল হস্ত নখ বাঁধাইয়া
    ।।
    বলে তোরে নখে চিরি করিব খানখান

    নৈলে “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” পুঁথি আন
    ।।
    মৃত্যুঞ্জয় দশরথ বর দিয়াছিল

    চতুর্ব্বিংশ বর্ষ এই গত হয়ে গেল
    ।।
    পুঁথি যদি না লিখিবি তোর রক্ষা নাই

    পুস্তক লিখিস যদি ছেড়ে দিয়ে যাই
    ।।
    স্বীকার করিনু আমি লিখিব পুস্তক

    কেমনে লিখিব আমি মূর্খ অপারক
    ।।
    শুনিয়া গোস্বামী অতি ক্রোধভরে কয়

    তুই মূর্খ প্রভুর লীলা ত মূর্খ নয়
    ।।
    গোস্বামী বলেন বেটা বুঝে দেখ সুক্ষ্ম

    তুই মূর্খ মহতের বর নহে মূর্খ
    ।।
    উপাধি দিয়াছে তোরে রসনা বলিয়া

    এত দিন পরে তাহা গিয়াছে ফলিয়া
    ।।
    কবি গাও কালিয়ার পন্ডিত সমাজ

    উপাধি দিয়াছে তোরে কবি রসরাজ
    ।।
    হরিবংশে হরিপুত্র গুরুচাঁদ যিনি

    তিনি দেন উপাধি প্রেমিক শিরোমণি
    ।।
    ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ বহুগুনে গুণী

    তিনি দেন উপাধি সরকার চূড়ামণি
    ।।
    ইতিনার ভট্টাচার্য্য পাড়া হয় গান

    সুকবি বলিয়া তোরে দিয়াছে আখ্যান
    ।।
    রজত ম্যাডেলে সেই উপাধি লিখিয়া

    তোমার গলায় সবে দিল ঝুলাইয়া
    ।।
    কেন বল আমি নাহি জানি ব্যাকরণ

    এখন সাহস ভরে লিখিতে দে মন
    ।।
    যে লেখা যে পড়া জান তাহা উঘাড়িয়া

    দেশ ভাষা মতে দাও পুস্তক রচিয়া
    ।।
    যুবা বুড়া সবে যাতে বুঝিবারে পারে

    সেই মত লিখে দাও আমাদের বরে
    ।।
    স্বপনেতে কেহ যদি পুথি করে দান

    সে জন পন্ডিত হয় পুরাণে প্রমাণ
    ।।
    বিরাজা নামেতে মধু কাণের ভগিনী

    স্বপনেতে পুথি তোরে দিল আমি জানি
    ।।
    এক দিন স্বপনে সাপের পা দেখিলি

    সে সব বৃত্তান্ত বাছা কেন ভুলে গেলি
    ।।
    স্বপনেতে এক নারী ঢাকার সহরে

    হরিচাঁদ স্তবাষ্টক দিয়াছিল তোরে
    ।।
    তোর লেখা স্তব তোরে সেই নারী দিল

    সেই স্বপ্ন কেন বাছা তোর ভুল হ
    ।।
    আনুকূল্যে গোলোক পাগল চূড়ামণি

    রচিল তারক সরকার চূড়ামণি
    ।।

    কবি জন্মোপাখ্যান।
    পয়ার।
    ওরে বৎস শোন তোর জন্ম বিবরণ।
    তুই যে জন্মিলি তোর পিতার সাধন।।
    দেখেছিস বাল্যকালে তোর খুল্লতাত।
    জন্ম-অন্ধ নাম তার ছিল শম্ভুনাথ।।
    তোর জন্ম বিবরণ তোর মনে নাই।
    মৌখিক শুনিলি তোর পিসিমার ঠাই।।
    তোর পিতা কাশীনাথ ছিল কালী ভক্ত।
    শক্তি আরাধিত কালীপদে অনুরক্ত।।
    অপুত্রক ছিল বংশে পুত্র না জন্মিল।
    বংশ রক্ষা হেতু দুর্গা বলিয়া কাঁদিল।।
    বটপত্রে লক্ষ দুর্গা নাম লিখে পরে।
    সপ্তাহ পর্যন্ত শিব স্বস্ত্যয়ন করে।।
    আচার্য ফকিরচাঁদ করে স্বস্ত্যয়ন।
    স্বস্ত্যয়ন করি বলে বলে জন্মিবে নন্দন।
    স্বর্ণময়ী দশভুজা মূর্তি গঠি লয়।
    পূজা করিলেন শুভ-নবমী সময়।।
    শ্রীনবকুমার শর্মা পুরোহিত এসে
    পূজা করে জগদ্ধাত্রী পূজার দিবসে।।
    সপ্তাহ পর্যন্ত চণ্ডী করিল পঠন।
    অষ্টম দিবসে দিল ব্রাহ্মণ ভোজন।।
    নবমী দিবসে পূজা কৈল ভবানীর।
    তব পিতা বুক চিরে দিলেন রুধির।।
    মার্গশীর্ষ অমাবস্যা শনিবার দিনে।
    তোর মাতা প্রসব করিল শুভক্ষণে।।
    নাম করণেতে নাম রাখিল তারক।
    আচার্য বলিল পুত্র হইবে রচক।।
    যেই নারী স্তবাস্টক দিলেন তোমায়।
    সেই শক্তি দিবে শক্তি রচনা সময়।।
    যে কথা লিখিতে সন্দেহ হইবে তব।
    সেও শক্তি দিবে তোরে আমি শক্তি দিব।
    যে সময় জীবনান্ত হইল আমার।
    কোলে করি ধরেছিলি মম কলেবর।।
    হরিসুত গুরুচাঁদ আজ্ঞা অনুসারে।
    রচনা করহ শীঘ্র নির্ভয় অন্তরে।।
    পূর্বে ছিল মুনিগণ করিতেন ধ্যান।
    এবে সেই ধ্যান হয় জ্ঞানেতে বিজ্ঞান।।
    পঙ্গুজন লঙ্ঘে গিরি বোবা কথা কয়।
    অন্ধজন চক্ষে দেখে মহৎ কৃপায়।
    বাজীকর ছায়াবাজী দেখায় বিপুল।
    নাচাইতে পারে তারা কাষ্ঠের পুতুল।।
    গোস্বামী গোলোক দশরথ মৃত্যুঞ্জয়।
    তুই কাষ্ঠ পুত্তলিকা তেমনি নাচায়।।
    বালকেরা খেলে যেন কড়িখেলা দান।
    নানাভাবে পড়ি কড়ি গড়াগড়ি যান।।
    কড়িতে না জানে আমি কি খেলা খেলাই।
    খেড়ুবিনে সে খেলা বুঝিতে সাধ্য নাই।।
    মৃত্যুঞ্জয় দশরথ আর মহানন্দ।
    তোরে করে ফেলাফেলি তাদের আনন্দ।।
    শীঘ্র করি লেখ মোর প্রভুর মহিমে।
    লেখ লেখ যাহা তোর উঠিবে কলমে।।
    যা দেখিস যা শুনিস তাহাতো লিখিবি।
    না দেখিলি না শুনিলি কেমনে পারিবি।।
    কোন ঠাই লিখিতে হইলে কিছু সন্ধ।
    আরোপে দেখিল হরি চরণারবিন্দ।।
    অজ্ঞান অবিদ্যা নাশ হবে অত্রানন্দ।
    হৃদয় আসিয়া লেখাইবে হরিচন্দ্র।।
    এভাবে গোলোকচন্দ্র সদয় হইল।
    হরি হরি বল ভাই তারক রচিল।।

    গ্রন্থকারের অনুনয়ন।
    ত্রিপদী।
    গোস্বামীর অনুমতি        বন্দি মাতা সরস্বতী
    মুঢ় মতি আমি অভাজন।
    শক্তিময়ী দিয়া শক্তি      আমা দ্বারা কর উক্তি
    পঞ্চাশ বর্ণ স্বর ব্যঞ্জন।
    নাহি মোর বর্ণ জ্ঞান       নাহি সূক্ষ্মানুসন্ধান
    সাহসিনু লিখিতে পুস্তক।
    যদ্যপি জ্ঞানবিহীন         তবু মম শুভদিন
    লিখিতে এ হাতের সার্থক।।
    হৃদিপদ্ম প্রস্ফুটিত          মন বড় আনন্দিত
    রচিতে হরি চরিত্র লীলা।
    এই মঙ্গলাচরণ            ভব বন্ধন মোচন
    শুনিতে মঙ্গল সুশৃঙ্খলা।।
    কৃষ্ণসারচর্ম দলে          কুঠার বাঁধিয়া গলে
    অই দলে জুড়ি দুই হাত।
    দন্তে তৃণ ধরি কেঁদে       সাধু বৈষ্ণবের পদে
    কোটি কোটি করি দণ্ডবৎ।।
    হরি কথা লীলামৃত        কে বলিতে পারে কত
    যে যত বা করেন প্রকাশ।
    মুনিগণে লেখে যত        ধ্যান অনুযায়ী মত
    বেদব্যাস কবি কৃষ্ণদাস।।
    লেখে যদি শূলপাণি       বাণী যদি বলে বাণী
    তবু বাণী অবধি না হয়।
    আমি যে সাহস করি       লিখিতে কলম ধরি
    সাধু গুরু বৈষ্ণব কৃপায়।।
    কার্য অতি দুরারোধ্য      লিখিতে নাহিক সাধ্য
    হেন সাধ্য যেন তেন মতে।
    লিখি লীলা গুহ্য বাহ্য     গ্রন্থকার মনোধার্য
    পূজ্য হোক ভক্ত সমাজেতে।।
    বেদব্যাস মহামুনি         যত লিখিলেন তিনি
    চারিবেদ আঠার পুরাণ।
    শাস্ত্র লেখে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম      গ্রন্থ লেখে লক্ষ লক্ষ
    দেখিল যাহা করিয়া ধ্যান।।
    একদা বদরিকাশ্রমে       ব্যাসমুনি ছিল ঘুমে
    হেনকালে আসি দুই পাখী।
    বদরী শাখা উপরে         দুই পাখী শব্দ করে
    ব্যসদেব মেলিলেন আঁখি।।
    শাখে বসি দুই শুকে       একটি কহিছে সুখে
    অবিরত ত্রয়োস্ত্রিংশৎ।
    অন্যটির মুখে বাণী         শুনিতেছে ব্যাসমুনি
    উঠে ধ্বনি পঞ্চাশৎ।।
    বাণী শুনি অকস্মাৎ        ব্যাস করে দৃষ্টিপাত
    পাখী কেন সংস্কৃত কহে।
    তাহা শুনিয়া বিস্ময়       সত্যবতীর তনয়
    কিঞ্চিৎ ধ্যানস্থ হয়ে রহে।।
    ধ্যানেতে হইল জ্ঞাত      উভয় পাখীর তত্ত্ব
    ত্রয়োস্ত্রিংশৎ যে করে প্রকাশ।
    অইটি বাল্মীকি মুনি       দেখেছেন ব্যাস মুনি
    পঞ্চ পঞ্চাশৎ কহে ব্যাস।।
    পাখী কহে সংস্কৃত         ইহার কারণ অর্থ
    জানিবারে পুনঃ করে ধ্যান।
    বাল্মীকি কহিছে বাণী      রচি রামায়ণ খানি
    করিয়াছি নামের বাখান।।
    ধর্ম অর্থ পাপ পুণ্য         ব্যবস্থা হয়েছে ধন্য
    প্রথম পুরুষ রামলীলে।
    বৈকুণ্ঠ নায়ক হরি          যৈছে অবতারকারী
    বর্নিলাম স্বয়ং হরি বলে।।
    স্বয়ং কৃষ্ণলীলা সার       শুদ্ধ মানুষাবতার
    তাঁর তত্ত্ব তাঁর প্রাপ্তি কিসে।
    তাহা আমি লিখি নাই     ধ্যানেতে ও নাহি পাই
    তুমি তাহা লেখ অবশেষে।।
    ব্যাস কহে শুক পাখী      আমি যে ভারত লিখি
    বৈকুণ্ঠ পতির সব লীলা।
    বাসুদেব যদুবংশ                    নারায়ণ কৃষ্ণ অংশ
    লিখি তার ঐশ্বর্যের খেলা।।
    লিখিবারে তার মর্ম        ব্যাখ্যা করিয়াছি ব্রহ্ম
    স্বয়ং কৃষ্ণ মাধুর্যের সার।
    কোন প্রেমে তারে পাই   আমি তাহা লিখি নাই
    তুমি তাহা করহে প্রচার।।
    গ্রন্থ হবে ভাগবত          সাধুজন মনোমত
    ব্রজভাব মাধুর্যের ধার্য।
    গ্রন্থ হবে পরচার                    ভক্তিরস তত্ত্বসার
    রসিক ভকত শিরোধার্য।।
    শুনি ব্যাস ভাবে মনে     ব্যাস কহে ব্যাস স্থানে
    এরা দুই শুক শ্যাম শুক।
    এরা কহে রচিবারে        এ রচনা রচিবারে
    এবে আমি না হব ইচ্ছুক।।
    ফিরে যাক যোগে বসা    দেখি করিয়া তপস্যা
    তপস্যায় বসিলেন মুনি।
    কতদিন গত হয়                    দৈবে এমন সময়
    শুনিতে পাইল দৈববাণী।।
    শীঘ্রই রচনা কর                    বৃথা কেন কাল হর
    উপলক্ষ তোমারে রাখিব।
    লিখিতে উদ্যোগী হও     করে তুলি তুলিলও
    যা করিবে আমি সে করিব।।
    এই দৈববাণী শুনি         লিখিতে লাগিল মুনি
    কৃষ্ণলীলা রস ভাগবত।
    লিখিতে লিখিতে গ্রন্থ      ব্রজলীলার বৃত্তান্ত
    ব্রজলীলা লিখে মনোরথ।।
    শান্ত দাস্য সখ্য আদি      বাৎসল্যের নিরবধি
    মধুরের রাধা প্রেমরস।
    দাস্য শান্ত ক্রিয়াগুণ        লিখিতে হল নিপুণ
    মধুরের ক্রিয়া গুণ যশ।।
    লিখিতে উদ্যত হ      হেন কালেতে শুনিল
    দৈববাণী হল পুনর্বার।
    আর না লিখ আগত       ব্রজভাব তত্ত্ব যত
    তা লিখিবে নন্দন তোমার।।
    পরে ব্যাস পুত্র যিনি       শুকদেব মহামুনি
    তিনি লিখিলেন ভাগবত।
    লিখিতে লিখিতে মুনি     পরে হল দৈববাণী
    আর না লিখিও তুল হাত।।
    কতদিন গত হ        ব্যাস ভাবিতে লাগিল
    আমি লিখি আমি করি সই।
    যদ্যপি লেখান হরি        জানিতে তা আমি পারি
    অন্যে তাহা জানিল বা কই।।
    দৈববাণী শুনিলাম         আমি একা জানিলাম
    গ্রন্থ মান্য হবে স্বর্গমর্ত্য।
    গোলোক বৈকুণ্ঠ মান্য     হইল যে গ্রন্থ ধন্য
    দেবগণে না জানিল তত্ত্ব।।
    গোলোক বিহারী হরি      গণপতি রূপ ধরি
    য়েছেন শিবের নন্দন।
    কোলে করিয়া ভবানী     ল গণেশ জননী
    কোলে আদি ব্রহ্ম সনাতন।।
    এবে বক্তা আমি হ     গণেশেরে লেখাইব
    চলিলেন কৈলাশ শিখর।
    স্তব করে মহামুনি         ব্যাসের স্তবন শুনি
    তুষ্ট হল দেব দিগম্বর।।
    আজ্ঞা দিলেন গণেশেরে যেতে ব্যাস সমিভ্যারে
    গণেশ বলিল আমি যাব।
    বলিতে বিলম্ব হলে       হস্ত অবসর পেলে
    লিখিব না ফিরিয়া আসিব।।
    শুনি ব্যাস চমকিত        হইলেন উপস্থিত
    বৈকুণ্ঠ নারায়ণ সদনে।
    গললগ্নী কৃতবাসে          স্তব করে পীতবাসে
    তুষ্ট হরি ব্যাসের স্তবনে।।
    ব্যাস কহিছে ভারতী       ভারতে যাবে ভারতী
    ভাগবত-ভারত রচনে।
    আমি যা বলিব বাণী       বাণী যোগাইবে বাণী
    বসি মম রসনা আসনে।।
    আজ্ঞা দেন চক্রপাণি       আজ্ঞায় চলিল বাণী
    গজানন কহে পুনর্বার।
    কণ্ঠে রহিবে ভারতী        বলিবেন যে ভারতী
    লিখিব হে যে সাধ্য আমার।।
    কালি হলে মসিপাত্র      মসি ফুরাইলে মাত্র
    আর না লিখিব যাব ফিরি।
    শুনি ব্যাস বারিনেত্র       আমি হব মসিপত্র
    ডেকে কন শ্বেত বাগীশ্বরী।।
    শুনিয়া এ সব বার্তা        ব্যাস মুনি করে যাত্রা
    গোলোকের পানে চাহি কাঁদে।
    গোলোকে ছিলেন স্থিতি যিনি নীল সরস্বতী
    তাকে করে আজ্ঞা কালাচাঁদে।।
    বৈকুণ্ঠেতে শ্বেতবাণী       মসিপত্র হবে তিনি
    তুমি গিয়া হও তাতে মসী।
    কজ্জ্বলস্বরূপা হয়ে         তুমি তাতে থাক গিয়ে
    আমি তব পিছে পিছে আসি।।
    আসি ব্যাস মুনিবর        গণেশের বরাবর
    কহে দেব লিখ কহি কথা।
    ডেকে বলে শিব-পুত্র      দিলে মোরে মসিপত্র
    লিখিবার লেখনিটা কোথা।।
    এরণ্ডের কুঞ্চি আনি       দিলা ব্যাস মহামুনি
    অস্ত্র দিল প্রস্তুতে কলম।
    কূপিলেন গজানন         ক্রোধে ঘূর্ণ ত্রিনয়ন
    বলে ব্যাস তোর মতিভ্রম।।
    বাণী কণ্ঠে বিরাজিত       শ্বেত সরস্বতী দত
    কালী হল নীল সরস্বতী।
    এতে মোর আসে হাস     তার কি কলম বাঁশ
    কি পত্রে বা লিখাইবি পাঁতি।।
    গিয়া বৃন্দাবন বাসে        ভ্রমণ চৌরাশী ক্রোশে
    বেল ভাণ্ডি তমালের বন।
    বন ভ্রমি একে একে       গন্ধরাজ শেফালিকে
    তালতরু দেখে হৈল মন।।
    বসি তালতরু মূলে         ভেসেছে নয়ন জলে
    হরি বলে কাঁদি উচ্চৈঃস্বরে।
    আমি শক্তি কৃষ্ণাঙ্গিনি   ভাগবত শাস্ত্র মুনি
    লেখ তুমি মম বক্ষঃ পরে।।
    দেখে পরাশর পুত্র         পড়িতেছে তালপত্র
    তালপত্রে কহে মুনিবর।
    যাহ শ্রীকৃষ্ণের ঠাই        বলগে বলেছে রাই
    শিরে শিখিপাখা দিতে মোরে।।
    ব্যাস অতি ব্যস্ত হয়ে     শ্যামকুণ্ড তীরে গিয়ে
    করেছেন কৃষ্ণ আরাধন।
    যুগল মিলন হয়ে         ব্যাসের সম্মুখে গিয়ে
    রাধা কৃষ্ণ দিল দরশন।।
    বলেছেন শ্রীরাধিকে       যা লিখিবে মম বুকে
    অন্য কলমে তা কি হয়।
    শুনিয়া রাধার বাণী        রাধানাথ রসখনি
    শিখিপাখা দিলেন তাহায়।।
    শিখিপুচ্ছ অংশ করি       ব্যাসেরে দিলেন হরি
    হাসিয়া বলে রাধানাথ।
    যাহা অনন্ত গোচরে        জিহ্বা সে দিবে তোমারে
    তাহাতে না কর অস্ত্রাঘাত।।
    উদয় ক্ষীরোদ কূলে       তপ করে হরি বলে
    হরি ছিল অনন্ত শয়নে।
    ফণা এক কোন হতে     এক জিহ্বা হৈল তাতে
    এনে দিল ব্যাসমুনি স্থানে।।
    বলীকে ছলিতে হরি       নাভি হতে পদতরী
    বাহির করিল যে প্রকার।
    তেমনি অনন্ত ফণা         জিহ্বাকণা এককণা
    প্রকাশিল ক্ষীরোদ ঈশ্বর।।
    কলম কালি সহিত        সুচিক্কণ মনোগীত
    মিশ্রিত করিলা শিখিপুচ্ছে।
    বাসুদেব নন্দসুত                    ঘন সৌদামিনীবৎ
    অঙ্গে অঙ্গ মিশ্রিতায় যৈছে।।
    তেমনি মিশ্রিত হ      কলম আনিয়া দিল
    গণেশের কলম করেতে।
    মসী নীল সরস্বতী         মস্যাধারে শ্বেত সতী
    গণপতি লাগিল লিখিতে।।
    ব্যাসের মুখ নিঃসৃত       গণেশের নিজ হস্ত
    লিখিল ভারত ভাগবত।
    আমি অতি অভাজন       হীন সাধন ভজন
    বিদ্যাহীন না জানি সংস্কৃত।।
    ত্রেতাযুগে সেতুবন্ধে       ভল্লুক বানরবৃন্দে
    বড়বৃক্ষ আনে বড় বীরে।
    বড় বড় যে পর্বত          বানরেরা আনে কত
    হনুমান লোমে বন্ধি করে।।
    রামকার্য করিবারে         ব্যস্ত ভল্লুক বানরে
    কাষ্ঠ বিড়ালের হৈল মন।
    পড়িয়া সমুদ্র নীরে         গড়াগড়ি দিয়া তীরে
    সেতুবন্ধ উপরে গমন।।
    মনে মনে বিবেচনা       শ্রীপদে পাবে বেদনা
    বালি দিলে খাদ পূর্ণ হয়।
    পন্থা হয় সুকোমল         যতেক কাষ্ঠ বিড়াল
    কার্য করে সাধ্য অনুযায়।।
    সেইমত লিখি পুঁথি        হরিচাঁদ লীলাগীতি
    রামকার্য মাজ্জারের ন্যায়।
    আমি অজ্ঞ নাহি যোগ্য    মার্জার হতে অযোগ্য
    হরিলীলা মহাযোগ্য প্রায়।।
    সজ্জনের দয়াগুণ                    হরিচাঁদ লীলাগুণ
    প্রকাশিয়া সে গুণ গাওয়ায়।
    যদ্যপি লেখনী ধরি        বলি এ বিনয় করি
    শ্রোতাগণ মহাজন পায়।।
    শ্রোতাগণ হংসবৎ         দোষ ছাড়ি গুণ যত
    দুগ্ধবৎ করুণ গ্রহণ।
    হরিলীলামৃত কথা         তেমনি করি মমতা
    কর্ণপথে পিও সর্বজন।।
    হরিলীলা শ্রবণেতে        ভবসিন্ধু পারে যেতে
    পাতকীর নাহি আর ভয়।
    ঘুচিবে শমন শঙ্কা        হরিনামে মার ডঙ্কা
    ধর পাড়ি ভাস ঐ নায়।
    দশরথ হীরামন           মহানন্দ শ্রীলোচন
    রামকান্ত যশোমন্ত পদে।
    গুরুচাঁদ কৃপালেশ                    গোলোক নৃসিংহ বেশ
    তারক রচকাভয় সাধে।।

    শ্রীমদ্ ব্রজনাথ পাগলোপাখ্যান।
    পয়ার।
    সুধারস আশ্চর্য লীলার বিবরণ।
    ব্রজনাথ উপাখ্যান শুন সর্বজন।।
    ব্রজনাথ নামে এক প্রভুর ভকত।
    বাল্য হতে গুরু সেবা করে অবিরত।।
    গুরুপদে ছিল আর্তি দৃঢ় ভক্তি তার।
    গুরুকার্য বিনে তার কার্য নাহি আর।।
    জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ড কিছু না মানিত।
    জ্ঞানশূন্য ভক্তি অঙ্গ প্রেমে পুলকিত।।
    সর্বদা উন্মাদ দশা চিন্তা জাগরণ।
    ভাবনা জড়িমা কৃতি প্রলাপ বচন।।
    গুরুপত্নী আজ্ঞা দিল কার্যান্তরে যেতে।
    ব্রজ রহে জ্ঞানশূন্য গুরু আরোপেতে।।
    ব্রজ তাহা নাহি জানে নাহি বাহ্যস্মৃতি।
    ঠাকুরানী কহিলেন ঠাকুরে সম্প্রতি।।
    আমি যাহা কহি তাহা নাহি কর গ্রাহ্য।
    এ শিষ্য রাখিয়া তব হবে কোন কার্য।।
    গৃহস্থের বাড়ী থাকে নাহি জ্ঞান বাহ্য।
    মিছা এরে খেতে দেওয়া শীঘ্র কর ত্যজ্য।।
    পাগলা স্বভাব ব্রজ নৈষ্ঠিক আচারে।
    ঠাকুরানী সেই ভাব বুঝিতে না পারে।।
    ঠাকুরানী কথা শুনি ঠাকুর ভুলিল।
    ব্রজনাথে বলে যেতে ব্রজ না উঠিল।।
    ব্রজভাবে মত্ত ব্রজ অঙ্গভঙ্গী করে।
    নির্বোধ ভাবিল, ব্রজ ব্যঙ্গ করে মোরে।।
    ক্রোধভরে ব্রজোপরে রুষিল ঠাকুর।
    পাদুকা ধরিয়া দণ্ড করিল প্রচুর।।
    হেন কালে ব্রজের হইল স্মৃতি জ্ঞান।
    গুরু কেন দণ্ড করে না বুঝি সন্ধান।
    পায়ের খড়ম ধরি করেন প্রহার।
    ব্রজ বলে কি স্বার্থক জনম আমার।।
    হইয়াছে গুরু সেবা যে ত্রুটি আমার।
    প্রতিশোধে করে গুরু পাদুকা প্রহার।।
    দণ্ড পরিমাণে তার বেদনা যে কম
    প্রহারে ভাঙ্গিল তার হাতের খড়ম।।
    ব্রজ কহে শিষ্য নহে আমি দুষ্ট ভণ্ড।
    নৈলে কেন গুরু হেন করে গুরুদণ্ড।।
    আমাকে মারিয়া গুরু হাতে পেল ব্যথা।
    বুঝিতে না পারি আমি অপরাধ কোথা।।
    কি বুঝিয়া গুরু মোরে এতেক বৈমুখ।
    সে ব্রজনাথের মনে হৈল বড় দুঃখ।।
    গুরু অপরাধী তার জীবনে কি ফল
    জীবন ত্যজিতে ব্রজ হইল চঞ্চল।।
    মনোদুঃখে ধারা চক্ষে কাতর অন্তরে।
    ধীরে ধীরে যায় ব্রজ চকের ভিতরে।।
    সেই চকে আছে এক হিজলীকা বৃক্ষ।
    জনরব আছে গাছে থাকে এক যক্ষ।।
    একাকী পাইলে কারে করয় সংহার।
    রাত্রে কেহ নাহি যায় দিনে লাগে ডর।
    আরো সেই গ্রামে ছিল শার্দূলের ভয়।
    দুরন্ত সদন্ত বরা চকেতে ভ্রময়।।
    হিজলীকা বৃক্ষমূলে ব্রজ বসে রয়।
    নিশাকালে ব্যাঘ্র ডাকে ব্রজ ডাকে আয়।।
    শার্দূল আসিয়া ব্রজনাথকে ধরিল।
    অঙ্গ ঘ্রাণ লয়ে ব্যাঘ্র ফিরিয়া চলিল।।
    দাঁতাল বরাহ আসে গণ গণ করি।
    ব্রজ ডাকে আয় আয় বলে হরি হরি।।
    শার্দূল না মারে মোরে তুই মোরে মার।
    গুরু ত্যাগী দেহে মোর নাহি দরকার।।
    শার্দূল বরাহ এসে তরাসে পালায়।
    ব্রজ ভাবে খাক্ ওরা তারা নাহি খায়।।
    হিংস্রক শার্দূল বরা হিংসা নাহি করে।
    আশ্চর্য গণিয়া ব্রজ ভেবেছে অন্তরে।।
    এবে বুঝি মৃত্যু নাই মৃত্যু আছে পাছে।
    না জানি আমাতে গুরুর কোন কার্য আছে।।
    তবে কেন মৃত্যু ইচ্ছা এ বড় প্রমাদ।
    গুরু ঈশ্বরের কার্য কেন করি বাদ।।
    আমাতে কি কার্য আছে তার মনে আছে।
    বাঁচিবার চেষ্টা করি উঠি গিয়া গাছে।।
    মারে কি বাঁচায় তার মনে যাহা লয়।
    শ্রীগুরুর দেহ কেন আমি করি লয়।।
    বৃক্ষোপরে উঠিল সে ভক্ত ব্রজনাথ
    দেখে এক মহামূর্তি হইল সাক্ষাৎ।।
    বলে ব্রজা আলি কেন এই বৃক্ষপর
    আমি কাল এই বৃক্ষে মম অধিকার।।
    ব্রজ বলে যেই মার সেই মোর কাল।
    যাহা ইচ্ছা তাহা কর শ্রীনন্দ দুলাল।।
    সে মহাপুরুষ কহে নাহি তোর কষ্ট।
    আমি তোর কৃষ্ণ হই আমি তোর ইষ্ট।।
    যশোদা দুলাল আমি ভকত বৎসল।
    তোর জন্য বাছা আমি হয়েছি পাগল।।
    গুরুমন্ত্র লয় জীবে মোরে পাইবারে।
    এই আমি পশিলাম তোমার শরীরে।।
    গুরুনিষ্ঠা লোক হয় আমার পরাণ।
    তুই মোর প্রাণ বাছা আমি তোর প্রাণ।।
    দুষ্ট দুশ্চারিণী তোর গুরুর রমণী।
    গুরুদণ্ড করিল তোমারে যাদুমণি।।
    গুরুপাট নিকটেতে আর নাহি যেও।
    হরি বলে ঘরে ঘরে ভিক্ষা করে খেও।।
    এবে আমি হইয়াছি যশোমন্ত সুত।
    তোমার দেহেতে হইলাম আবির্ভূত।।
    মুখডোবা ছিনু বাসুদেব মূর্তি ধরে।
    যশোমন্ত সুত হইনু রামকান্ত বরে।।
    পরশুরামের দেহে বিষ্ণুতেজ ছিল।
    রামের দেহেতে তেজ যেমন মিশিল।।
    যশোমন্ত সুত দেখা যেখানে পাইব।
    আমি গিয়া সেই দেহে মেশামেশি হব।।
    তোমা হেন ভক্ত ছেড়ে না যাব কখনে।
    আমি তোর তুই মোর জীবনে মরণে।।
    এত শুনি ব্রজনাথ ভ্রমিয়া বেড়ায়।
    কখন বা বৃক্ষতলা কখন আলয়।।
    মনে চিন্তা যশোমন্ত সুত কোন জন।
    কবে তার শ্রীঅঙ্গ করিব দরশন।।
    এদিকেতে সফলানগরে প্রভু বাস।
    ব্রজনাথ মিলনেতে মনে হল আশ।।
    উত্তরাভিমুখে প্রভু একদিন চলে।
    ডাকে প্রভু আহারে ব্রজারে কোথা বলে।।
    এমন সময় উপস্থিত ব্রজনাথ।
    বসাইল প্রভু তারে হাতে ধরে হাত।।
    নাটু আর বিশ্বনাথ সঙ্গে দুইজন।
    দোঁহে দেখে দুজনার অপূর্ব মিলন।।
    বার তের বৎসর বয়স এক ছেলে।
    পরিধান পীতাম্বর বনমালা গলে।।
    রতন বলয় হাতে চরণে নুপুর।
    নবঘনশ্যাম বর্ণ মুরতি মধুর।।
    শিরে শোভে শিখিপাখা করে শোভে বাঁশী।
    বিধুমুখে মধুমাখা মৃদু মৃদু হাসি।।
    ব্রজনাথ অঙ্গ হতে উঠে এক জ্যোতি।
    সেই জ্যোতি হতে এই মধুর মুরতি।।
    ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিম বাঁকা হাসি কথা কয়।
    হরিচাঁদ শ্রীঅঙ্গেতে সে অঙ্গ মিশায়।।
    ঠিক যেন ব্রজধামে যমুনা মাঝেতে।
    বাসুদেব পড়ে বসুদেব হাত হতে।
    সেই দেহে আবির্ভূত গোলোকবিহারী।
    বসুদেব সেই পুত্রে নিল কোলে করি।।
    যশোদার গর্ভে হয় যমজ সন্তান।
    সেই পুত্র এই পুত্র দোঁহে মিশে যান।।
    ভাগবতে শ্লোক আছে তাঁহার প্রমাণ।
    ব্যাসদেব রচিত শ্লোক শুকদেব গান।।

    শ্লোক
    বসুদেবগৃহে জাত বাসুদেহখিলাত্মনি।
    নীলনন্দসুতে রমা ঘনে সৌদামিনী যথা।।

    গর্গ উবাচ
    সত্যে শ্বেতবর্ণানি চ ত্রেতায়াং রক্তবর্ণানি।
    পীতবর্ণ তথা কলৌ ইদানিং কৃষ্ণতাং গতঃ।।

    পয়ার
    পীতবর্ণ কলিকালে যখনে গৌরাঙ্গ।
    দ্বাপরে নারদ কহে লীলার প্রসঙ্গে।।

    নারদীয় পুরাণে
    কলৌ প্রথমসন্ধ্যায়াং লক্ষ্মীকান্তো ভবিষ্যামি।
    সন্ন্যাসঃ গৌরবিগ্রহঃ সান্ত্বায়পুরুষোত্তম।।

    পয়ার
    স্বয়ং এর কার্যে জন্মে ব্রহ্মা ইন্দ্রে ভ্রম।
    কভু নাহি হয় তার গর্ভেতে জনম।।
    শচীগর্ভে অবতীর্ণ হইল প্রকাশ।
    ভারতীর কাছে যবে লইল সন্ন্যাস।।
    হা কৃষ্ণ বলিয়া প্রেমে হইল বিভোর।
    ভারতী কপিন দিল আর দিল ডোর।।
    কি মন্ত্র দেবেন তাই ভারতী ভেবেছে
    বলেন গৌরাঙ্গ প্রভু ভারতীর কাছে।।
    স্বপনে পেয়েছি মন্ত্র গুরু তোমা কই।
    ভারতী বলেন সন্ন্যাসের মন্ত্র অই।।
    সন্ন্যাস গ্রহণ হলে নামান্তর লাগে।
    কি নাম রাখিব গুরু ভেবেছেন যোগে।।
    হেনকালে শূন্যবাণী কহে থেকে শূন্য।
    রাখ নিমাইর নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।।
    সেই কালে নিত্যবস্তু হৈল আবির্ভূত।
    নৈলে কেনে দণ্ড ভাঙ্গে নিতাই অবধূত।।
    এইভাবে আবির্ভূত মিশামিশি হয়।
    অবতারে নিত্যযোগ নাহিক সংশয়।।
    নাটু আর বিশ্বনাথ এ লীলা দেখিয়া।
    হরি বলি বাহু তুলি উঠিল নাচিয়া।।
    ঠাকুর বলেন শুন ওরে ব্রজনাথ।
    যাবি না থাকিবি তুই আমাদের সাথ।।
    ব্রজনাথ বলে আমি আর কোথা যাব।
    প্রাণ থুয়ে কোথা গিয়ে এ দেহ জুড়াব।।
    রসনা বাসনা করে ব্রজনাথ সঙ্গ।
    ব্রজনাথ শান্তিনাথ দোঁহে এক অঙ্গ।।

    সফলানগরী শ্রীহরির আবির্ভাব ও শ্রীহরির অঙ্গে
    পয়ার
    সফলানগরী শ্রীহরির আবির্ভাব।
    ধন্য ধন্য বলিয়া হইল জনরব।
    শনিবার আর যে মঙ্গল বার হলে।
    ঠাকুর বসিত ঝোঁকে ঝোঁকে হেলে দুলে।।
    প্রাতঃসূর্য মত হত ঠাকুরের মুখ।
    কত লোকে গিয়া তথা দেখিত কৌতুক।।
    প্রাতঃ হতে প্রহরেক থাকিত তেমন।
    সকলে করিত হরিনাম সংকীর্তন।।
    ব্যধিযুক্ত লোক যত সেই খানে যেত।
    মুখের বাক্যতে সব আরোগ্য করিত।।
    একদিন হরি ঠাকুরের বার মানি।
    সফলানগরে হয় জয় জয় ধ্বনি।।
    মহাপ্রভু বলে ব্রজ চল মোরা যাই।
    কেমন হরির বার দেখে আসি তাই।।
    তাহা শুনি ব্রজনাথ সঙ্গেতে চলিল।
    দুই প্রভু একত্র হইয়া চলে গেল।।
    শ্রীহরি ঠাকুর মধ্যে লোক চতুঃপার্শ্বে।
    দুই প্রভু উপনীত হেনকালে এসে।।
    যখনে শ্রীহরিচাঁদ উপনীত হল।
    প্রাতঃসূর্য বর্ণ মুখ বিবর্ণ হিইল।।
    দিবসে উঠিলে চন্দ্র হীনপ্রভা যেন।
    শ্রীহরিদর্শনে তেম্নি সে হরি বিবর্ণ।।
    ছিল যে ঠাকুরের মুখ প্রাতঃসূর্য বর্ণ।
    মুখ হতে বাহিরিল সে জ্যোতি সম্পূর্ণ।।
    চতুঃপার্শ্বে লোক সব করিল দর্শন।
    হরিচাঁদ অঙ্গে জ্যোতি হৈল সম্মিলন।
    চুম্বকে চুম্বক দিয়া লৌহ টেনে লয়।
    মেঘে সৌদামিনী যথা হল তার প্রায়।।
    সে ঠাকুর জ্যোতি হরিচাঁদেতে মিশিল।
    ব্রজনাথে লয়ে হরি নিজালয় গেল।।
    তখন সে ডেকে বলে সব ভক্ত ঠাই।
    যে আমাতে ছিল বাপু সে আমাতে নাই।।
    এতদিন যার ধনে ছিনু অধিকারী।
    যার ধন সেই নিল কি করিতে পারি।।
    তবে যদি ভক্তি করি পার গো ডাকিতে।
    মুক্তি পাবে যার যার ভক্তির গুণেতে।।
    যে মানুষ মম দেহে আবির্ভূত ছিল।
    ঐ যে সে মানুষ মানুষে মিশিয়া গেল।।
    মানুষে মানুষ সঙ্গে মিশে গেল আজ।
    গেল রবি কহে ভাবি কবি রসরাজ।।

    ব্রজনাথের দ্বারা মৃত গরুর জীবন দান।
    পয়ার।
    ব্রজা পাগলা ব্রজা পাগলা বলে হল খ্যাতি।
    হরিচাঁদ হয়েছে সে ব্রজা পাগলার সাথী।।
    সংসারী সংসার কাজ কিছুই করে না।
    কোথাও বসিলে আর উঠিতে চাহে না।।
    ব্রজনাথ বিশ্বনাথ আর নাটু হরিচাঁদ।
    কয়জনে পাতিয়াছে পীরিতির ফাঁদ।।
    কভু বৃক্ষশাখামূলে কভু বৃক্ষমূলে।
    কভু গোচারণ মাঠে কভু ভূমিতলে।।
    বসিয়া থাকেন কয় প্রভু একত্তর।
    কোন কোন দিন গিয়া খায় কারু ঘর।।
    কেহ কেহ ডেকে লয় সেবার জন্যেতে।
    বিশার জননী দেন প্রায় সময় খেতে।।
    বেশী থাকে বিশাইর মাতার কাছেতে।
    মনে হলে কোন কাজ করে তৎক্ষণাতে।।
    তিনজনে কভু যদি কোন কাজ ধরে।
    দশ কিষাণের কাজ করে দিতে পারে।।
    কোনদিন কার্য নাহি করে দিনভরি।
    বড় কাজ করে যদি দণ্ড দুই চারি।।
    তাহাতে যে কার্য করে হেন জ্ঞান হয়।
    দশ দিনের কার্য করে মুহূর্ত সময়।
    বিশ্বনাথ বাড়ী কভু নাটুদের বাড়ী।
    কোন দিন কার্য প্রভু করে নিজ বাড়ী।।
    অধিকাংশ কাজ করে বিশেদের বাড়ী।
    অল্প অল্প কাজ করে নাটুদের বাড়ী।।
    মধ্যমাংশ কাজ করে প্রভু নিজালয়।
    হয় করে, নয় করে হরিগুণ গায়।।
    কোনদিন বসি প্রভু ঘুড়ি উড়াইত।
    নির্মিয়া মানুষ ঘুড়ি উড়াইয়া দিত।।
    প্রভু বলে ওরে বিশে দেখ তোরা চেয়ে।
    এইভাবে গুণ ধরি দিয়াছি উড়ায়ে।।
    ব্রজনাথ বিশে আর নাটুয়া পাগল।
    তাহা দেখি আনন্দে বলিত হরিবোল।।
    একদিন তিনজন প্রেমানন্দভরে।
    পতিত ভূমেতে বসে বাটীর উত্তরে।।
    ঠাকুরের নিজের পালের শ্রেষ্ঠ গরু।
    ব্যাধি হয়ে, হইয়াছি মরিবার শুরু।।
    ক্রমেই বাড়িল ব্যাধি গরু লালাইয়া।
    নাসারন্ধ্রে শ্লেষ্মা উঠে গিয়াছে পড়িয়া।।
    নোয়া কর্তা সেজ কর্তা গরুর নিকটে।
    গরু লয়ে পড়েছেন বিষম সংকটে।।
    বড় কর্তা ছোট কর্তা কহে উভয়েরে।
    কেন বসিয়াছ মরা গরু কোলে করে।।
    পেটফুলে উঠিয়াছে পা হয়েছে টান।
    দাঁতে দাঁতে লেগে গেছে উত্তার নয়ন।।
    বাঁচিবে না ঐ গরু প্রায় মরে গেছে।
    উঠে এস থাক কেন বলদের কাছে।।
    এত শুনি উঠে এল নিরানন্দ চিত।
    হেনকালে কয় প্রভু এসে উপস্থিত।।
    বসিয়াছে তিন প্রভু দিবা অবশেষ।
    বড়কর্তা কৃষ্ণদাস রাগে করে দ্বেষ।
    তিন জন ঠাকুরালী করিয়া বেড়াও।
    কি গুণেতে বসে বসে এত ভাত খাও।।
    ঠাকুর কোলায়ে এত ভাত খেয়ে ফের।
    গোগৃহে মরেছে গরু রক্ষা গিয়ে কর।।
    বেড়ায়ে খেয়ে খেয়ে করিলি পয়মাল।
    এই গরু বাঁচিলে বুঝিব ঠাকুরাল।।
    বিশারে বাঁচালি বলে ওরে হরিদাস।
    এই গরু বাঁচাইয়া খাওয়া দেখি ঘাস।।
    বড় সাধু ব্রজা তুই পাগল কোলাস।
    হরির সঙ্গেতে তুই অনেক বেড়াস।।
    এই গরু আজ যদি না পার বাঁচাতে।
    তাহলে তোদের আর নাহি দেব খেতে।।
    এত শুনি ব্রজ চাহে ঠাকুরের ভিতে।
    ঠাকুর ব্রজকে বলে দিলেন ইঙ্গিতে।।
    যারে ব্রজ আমি তোরে দেই অনুমতি।
    ওঠ বলি বলদেরে মার গিয়া লাথি।।
    হুঙ্কার করিয়া ব্রজ করি হরিধ্বনি।
    বলদেরে লাথি গিয়া মারিল অমনি।।
    ওঠ ওঠ ওরে গরু রলি কেন শুয়ে।
    অমনি উঠিয়া গরু গেল দৌড়াইয়ে।।
    যে পতিত জমিতে ঠাকুর বসে ছিল।
    সে জমিতে গিয়া ঘাস খাইতে লাগিল।।
    বড়কর্তা বলে ওরে ব্রজ হরিদাস।
    অপরাধী হইয়াছি তোমাদের পাশ।।
    আজ হতে চিনিলাম তোমা সবাকারে।
    এত বলি বড় কর্তা অনুনয় করে।।
    রচিল তারকচন্দ্র মহানন্দ ভাষে।
    বড়কর্তা সুখনীরে মহানন্দে ভাসে।।

    বড় কর্তার অনুনয়
    লঘু ত্রিপদী
    বড় কর্তা         কহে বার্তা        শুন হরিদাস।
    তব খেলা         সব লীলা         জগতে প্রকাশ।।
    এতদিনে         নাহি চিনে        কতযে বলেছি।
    ব্রজনাথে          বিশ্বনাথে         চিনেছি চিনেছি।।
    গেল চিন্তে        তোমাচিন্তে       আর চিন্তা নাই।
    মনোভ্রান্তে        তোমাচিন্তে       পারিনারে ভাই।।
    ধন্য মাতা        ধন্য পিতা        ধন্য তুমি ভাই।
    তোমা হেন       ভাই যেন         জন্মে জন্মে পাই।।
    ধন্য বংশ         অবতংশ          তুমিযে আসিয়ে।
    আমি ধন্য        জগন্মান্য         তোমা ভাই পেয়ে।।
    তুমি আদি        গুণনিধি                     পালক পালিকা।
    তুমি স্থুল         বৃক্ষমূল           মোরা পত্র শাখা।।
    ভক্তসঙ্গে         মনোরঙ্গে        বসে থাক ঘরে।
    দ্বারে দ্বারে        ভিক্ষা করে       খাওয়াব তোরে।।
    আর তিন         ভাই দীন         তারা শাখা পত্র।
    তব গুণে          জগজ্জনে         হইবে পবিত্র।।
    কর খেলা         সব বেলা         ভক্তগণ লয়ে।
    ক্ষুদা হলে       সবে মিলে        যেওরে খেয়ে।।
    আমি ভৃত্য       চির নিত্য        খাটিব সংসারে।
    তব সেবা         রাত্র দিবা         করিব সাদরে।।
    ভক্তিময়          অনুনয়           করে বড়কর্তা।
    শ্রীতারক          সুরচক           হরিলীলা বার্তা।।

    মহাপ্রভুর মহিমা প্রকাশ ও কুষ্ঠব্যাধি মুক্তির বিবরণ।
    দীর্ঘ ত্রিপদী।
    হরিকথা রসরঙ্গে          ভক্তগণ লয়ে সঙ্গে
    লীলা করে কৈশোর সময়।
    কৈশোরের অবশেষ       যৌবন প্রথমাবেশ
    ঈশ্বরত্ব প্রকাশিত হয়।।
    হরি পিতা যশোমন্ত       নরলীলা করি অন্ত
    শ্রীধাম গোলোকে চলে গেছে।
    শেষে ঘটিল প্রমাদ        জমিদার সঙ্গে বাদ
    সে প্রস্তাব লেখা হইতেছে।।
    যবে রামদিয়া যান        ব্রজনাথ সঙ্গে র
    বিশ্বনাথ সঙ্গে বেড়ায়েছে।
    নাটু এসে মিশে সঙ্গে     হরিনাম প্রেমরঙ্গে
    প্রেমানন্দে মত্ত হয়ে আছে।।
    এইভাবে কত লীলা       রাখালের সঙ্গে খেলা
    একদিন নিভৃতে বসিয়া।
    মুখে বলে হরিবোল        আসিয়া ব্রজ পাগল
    কহিতেছে কাঁদিয়া কাঁদিয়া।।
    করি না সংসার কাজ      কহিতে বড়ই লাজ
    শুন প্রভু আমি বড় ভণ্ড।
    আমি বড় অভাজন        মন্দ বলে গুরুজন
    ভাইসবে মোরে করে দণ্ড।।
    প্রভু বলে তারা ভণ্ড        তোরে যারা করে দণ্ড
    তাহা আমি জানি ভাল মতে।
    করেছে চপটাঘাত         আর করে মুষ্ট্যাঘাত
    সে আঘাত আমার অঙ্গেতে।।
    শ্রীঅঙ্গেতে ছিন্ন ভিন্ন      আছে প্রহারের চিহ্ন
    ভক্ত গণে করে অনুযোগ
    এ অঙ্গে করে প্রহার       সেই মুঢ় দুরাচার
    তার অঙ্গে হোক মহারোগ।।
    মেরেছিল বড় ভাই        তিন দিন মধ্যে তাই
    ঘটিল যে তাহার কপালে।
    মেরেছিল যেদিনেতে      সেই দিবস হইতে
    হস্ত তার উঠিয়াছে ফুলে।।
    বিষম হস্ত বেদনা          মহাব্যাধির সূচনা
    গায় মুখে চাকা চাকা হল।
    কিছুদিনের পরেতে        গলিত হইল তাতে
    ক্লেদ রক্ত বহিতে লাগিল।।
    যেদিন বলদ বাঁচে         অনেকে তাহা জেনেছে
    পরস্পর জানাজানি হয়।
    কেহ করিল বিশ্বাস        কেহ করে অবিশ্বাস
    কেহ এসে গরু দেখে যায়।।
    লোকমুখে শুনি কথা       ব্রজনাথ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা
    বলে ভাই ক্ষম অপরাধ।
    ছোট ভাই বলে গণি       তোমাকে নাহিক চিনি
    দোষ করে ঘটিল প্রমাদ।।
    ব্রজ বলে শুন ভাই         তব কিছু দোষ নাই
    কার কাজ কেবা যেন করে।
    যার কাজ সেই করে       লোকে বলে লোকে করে
    যা করে শ্রীহরিচাঁদ করে।।
    ক্ষমাকর্তা প্রেমকর্তা       রোগের আরোগ্য কর্তা
    কর্মকর্তা কর্ম অনুসারে।
    কেটে যাবে কর্মভোগ     আরোগ্য হইবে রোগ
    পার যদি ধর গিয়া তারে।।
    ঠাকুরের পদে পড়ি        ভূমে লুটে গড়াগড়ি
    শির কুটিবুকেতে কিলায়।
    ক্ষমা কর অপরাধ         ওহে প্রভু হরিচাঁদ
    পতিত পাবন দয়াময়।।
    বহু রোদনের পরে         হরিচাঁদ বলে তারে
    শোন যুক্তি মুক্তির বিধান।
    ব্রজনাথ পদানত                    য়ে খা চরণামৃত
    কনিষ্ঠকে জ্যেষ্ঠ করি মান।।
    যেইমাত্র করে তাই        আর তার ব্যাধি নাই
    সবে করে জয় জয় ধ্বনি।
    রোগেতে হইয়া মুক্ত      সেহলো প্রভুর ভক্ত
    ব্যক্ত হল অমনি অবনী।।
    ত্যাজিয়া গোলোকপুরী    ওঢ়াকাঁদি এল হরি
    অদ্বৈত গোলোক হুহুঙ্কারে।
    সুকবি তারকচন্দ্র                    বলে প্রভু হরিশচন্দ্র
    উর মম হৃদয় গহ্বরে।।

    প্রভুদের জমিদার সঙ্গে বিবাদ বিবরণ।
    ত্রিপদী।
    কৃষ্ণদাস হরিদাস,         আর শ্রীবৈষ্ণবদাস,
    তিন প্রভু যুবত্ব সময়।
    কৈশোরেতে গৌরিদাস,   আর শ্রীস্বরূপদাস,
    পঞ্চদেহে এক প্রাণ প্রায়।।
    প্রভুদের জমিদার,         সূর্যমণি মজুম্দার,
    অষ্টমের লাটের সময়।
    দুর্ভিক্ষে কষ্ট প্রজার,       আদায় না হয় কর,
    গোমস্তা ভাবিয়া নিরুপায়।।
    সফলাডাঙ্গা কাছারি,      চিন্তাকুল হয়ে ভারি,
    কিসে রক্ষা হবে রাজ্যপাট।
    কাছারিতে টাকা নাস্তি,    না দিলে অষ্টম কিস্তি,
    জমিদারি হয়ে যায় লাট।।
    গোমস্তা যাইয়া শেষে,     বড়কর্তা কৃষ্ণদাসে,
    বলিলেন অতি সকাতরে।
    আপনার জমিদার,        সূর্যমণি মজুম্দার,
    এ বিপদে কেবা রক্ষা করে।।
    শ্রেষ্ঠ প্রজা আপনারা,      দায়ে ঠেকেছি আমরা,
    বিপদে দিলাম এই ভার।
    এই তালুক সমস্ত,         যখনেতে বন্দোবস্ত,
    আপনি জামিন ছিলেতার।।
    বড়কর্তা দিল সায়,        কহে কত মুদ্রা দায়,
    করিব তাহার উপকার।
    মুদ্রা লব সাতশত,        গোমস্তা করে শপথ,
    পৌষমাস, শুধিব এ ধার।।
    গোমস্তার শুনি বাণী,       গৃহ হতে মুদ্রা আনি,
    অমনি দিলেন গোমস্তায়।
    গত হল পৌষমাস,       দুর্ভিক্ষ হল বিনাশ,
    ধার শোধিবারে নাহি যায়।।
    উৎপাদন হল ধান্য,       ধান্যে ধরা পরিপূর্ণ,
    প্রজাগণ হৈল বড় সুখী।
    শেষ চৈত্র মাস শুদ্ধ,       আদায় বকেয়া শুদ্ধ,
    প্রজাদের কর নাহি বাকী।।
    কৃষ্ণদাস বড়কর্তা,         গোমস্তারে কহে বার্তা,
    কড়ার হইল কেন ভ্রষ্ট।
    আদায় হইল কর,         বাকী না রহিল আর,
    ভূস্বামীর নাহি কোন কষ্ট।।
    গোমস্তা করে উত্তর,       আদায় হয়েছে কর,
    তোমাদের ধার শোধ দিতে।
    রাজার হুকুম নাই,         কারণ হয়েছে তাই,
    বিশেষতঃ ভ্রম মম চিতে।।
    এতেক শুনিয়া বার্তা,      ক্রোধে কহে বড়কর্তা,
    এ নহে সত্যের ব্যবহার।
    বিশ্বাসী লোকের স্থলে,    হেনরূপ নাহি চলে,
    বৃথা হল সত্য অঙ্গীকার।।
    শুন বলি মহাশয়,          নিবেদিতোমার পায়,
    কহ গিয়া জমিদার ঠাই।
    বৈশাখে কি জ্যৈষ্ঠ মাসে, কিস্তি আদায়ের শেষে,
    তখন আমার টাকা চাই।।
    ফিরে আসিল গোঁসাই,     গোমস্তা শুনিয়া তাই,
    কহে গিয়া জমিদার পাশে।
    অষ্টমের কিস্তি শেষে,     আগামীতে জ্যৈষ্ঠ মাসে,
    টাকা দিতে হবে কৃষ্ণদাসে।।
    জ্যৈষ্ঠ মাস গত হ,     আষাঢ় শ্রাবণ গেল,
    অষ্টম আদায় হৈল সায়।
    ধার নাহি দিল শোধ,      বড়কর্তা হয়ে ক্রোধ,
    গোমস্তার পার্শ্বে গিয়া কয়।।
    দায় ঠেকে জমিদার,      বিপদ হতে উদ্ধার,
    ধার করে তোমার দ্বারায়।
    হেন দায়ের কারণে,       আপনার কথা শুনে,
    টাকা দেই মুখের কথায়।।
    এখন এরূপ কার্য,          আর নাহি হয় সহ্য,
    গ্রাহ্য নাহি ধার শোধিবারে।
    ত্রেতাযুগে বিভীষণ,        বলেছিল যে বচন,
    তাই বুঝি ঘটিল আমারে।।
    বলিল রামের ঠাই,        রামায়ণে শুনি তাই,
    রাজত্ব ব্রহ্মত্ব কলি কালে।
    রাজা হবে হিংসুক,        ব্রাহ্মণ হবে মিথ্যুক,
    সেই দুই আমার কপালে।।
    যাতায়াতে হয়ে ত্যক্ত,   সহজে কহিয়া শক্ত,
    বিরক্ত হইয়া অতিশয়।
    নিজ গৃহে এল ফিরে,      কহিলেন সবাকারে,
    টাকা নাহি দিল গোমস্তায়।।
    প্রবঞ্চনা মহাকষ্ট,          ক্ষণে কাঁপে অধরোষ্ট,
    টাকা বলে নহে কিছু ক্ষুণ্ণ।
    মন্দের হল সূচনা,        কহে তারক রসনা,
    বিশ্বরূপ ক্রোধে পরিপূর্ণ।।

    জমিদারের অত্যাচার।
    পয়ার।
    ভাদ্রমাসে জমিদার কাছারী আসিয়া।
    অই সব বাচনিক শুনিলেন বসিয়া।।
    গোমস্তা বলিল সব বাবুর গোচরে।
    কৃষ্ণদাস কাছারী আসিয়া নিন্দা করে।।
    সহজে বিনয় করি রামায়ণ কয়।
    নিন্দা করিয়াছে তার মনে যত লয়।।
    বিভীষণের উপাখ্যান কহে বার বার।
    কলির ব্রাহ্মণ রাজা দুয়ের আচার।।
    শুনে বলিলেন মজুমদার মহাশয়।
    টাকাগুলি না দেয়া তবড়ই অন্যায়।।
    গোমস্তা বলিল যদি টাকা নিতে পারে।
    কাছারী আসিয়া কেন এত নিন্দা করে।।
    আছে নয় কৃষ্ণদাস বড় মান্যমান।
    তমে তম ভর্ৎসে মম কিসে থাকে মান।।
    মজুমদার বলে চল যাইব এখনে।
    এত নিন্দা করে কেন আসি গিয়া শুনে।।
    নৌকায় চলিল দুই পেয়াদা লইয়া
    গোমস্তার সঙ্গে ঘাটে উত্তরিল গিয়া।।
    গোমস্তা কহিছেকৃষ্ণদাসে ধরে আন।
    দুই বৎসরের কর দেনা কি কারণ।।
    পেয়াদা বাটীতে গিয়া বলে কৃষ্ণদাসে।
    খাজনার জন্য বাবু ডাকে ঘাটে বসে।।
    বড়কর্তা মাঝে মাঝে খাইতেন সিদ্ধি।
    সিদ্ধি মন্ত্র জপিতেন হইবারে সিদ্ধি।।
    যে সময় পেয়াদা আসিয়া ডাক দিল।
    সিদ্ধি সেবনের আয়োজন করেছিল।।
    সাজিয়া গাঁজার কল্কি দিতেছে আগুণ।
    সিদ্ধি সেবনের জন্য হইয়া নিপুণ।।
    পেয়াদারে বলে থাক কিছুকাল বসি।
    বল গিয়া জমিদারে গাঁজা খেয়ে আসি।।
    ধরিল গাঁজার কল্কি করজপ করি।
    গাঁজায় দিলেন টান বলে হরি হরি।।
    ক্ষণকাল দোম করি না ছাড়ি নিঃশ্বাস।
    হইল আরক্ত নেত্র যেন কৃত্তিবাস।।
    পেয়াদাকে কহে বাণী অন্তর নির্মল।
    কোথা আছে জমিদার চল দেখি চল।।
    ঠাকুর চলিল বড় হরষিত চিতে।
    টাকা বুঝি পাব আজ ভাবিল মনেতে।।
    বড়কর্তা জমিদারে সবিনয় কন।
    জ মম সুপ্রভাত রাজ দরশন।।
    আপনার বাড়ী এ যে আপনার ঘর।
    দয়া করে আসুন এ বাড়ীর উপর।।
    গোমস্তা কহিছে তুমি কর যে দিলে না।
    কর্তা বলে আগে শোধ কর মম দেনা।।
    গোমস্তা হুকুম দিল পেয়াদার পর।
    কৃষ্ণদাস কাছে লও দুই সোনা কর।।
    তব টাকা যেই জন হাওলাত নিছে।
    আদায় করগে টাকা গিয়া তার কাছে।
    কর্তা কহে আগে কি তোমার টাকা দিব।
    কিম্বা আমাদের টাকা অগ্রেতে পাইব।।
    খোদ কর্তা জমিদার কহিল বিহিত।
    আগে আগ পিছে পাছ এইত উচিৎ।।
    বড়কর্তা কহে বার্তা এই কথা ভাল
    বাবুর হুকুম মম টাকা গুলি ফেল।।
    গোমস্তা হুকুম দিল পেয়াদার ঠাই।
    আন ধরে কৃষ্ণদাসে বাকী কর চাই।।
    ঘাড় ধরে কৃষ্ণদাসে নৌকাপরে আন।
    এতেক আস্পর্ধা ওরে কর অপমান।।
    পেয়াদা এতেক শুনি গেল বাড়ীপরে।
    ধরিবারে গেলে ধরে অপমান করে।।
    পেয়াদার অপমানে গোমস্তা ধাইল।
    ঠাকুরের কয় ভাই রাগিয়া উঠিল।।
    গোমস্তারে ধরে দুই পেয়াদার সাথ
    মারিল চপেটাঘাত মুষ্টিক আঘাত।।
    এমতি মারিল মার দুষ্ট গোমস্তারে।
    মৃতপ্রায় হইয়া রহিল ভূমিপরে।।
    মজুমদার মহাশয় নৌকাপরে ছিল।
    নৌকা ধরে টেনে এনে কূলে উঠাইল।।
    ভয় পেয়ে জমিদার থরহরি কাঁপ।
    বলে ওরে কৃষ্ণদাস তুমি মোর বাপ।।
    প্রভু হরিচাঁদ বলে ক্ষমা কর দাদা।
    মার হইয়াছে যবে মেরেছ পেয়াদা।।
    বিশেষ ব্রাহ্মণ জাতি ব্রাহ্মবীজে জন্ম।
    বিশেষতঃ জমিদার মারিলে অধর্ম।।
    প্রভুমাতা অন্নপূর্ণা নিষেধে তখন।
    শুন ওরে কৃষ্ণদাস মেরনা ব্রাহ্মণ।।
    আমি যাহা বলি তাহা শুনরে সকলে।
    ভালভাবে নৌকা নামাইয়া দেও জলে।।
    পেয়াদা গোমস্তা দেও নায় উঠাইয়া।
    হোক্গিয়া বড় মানুষ এ টাকা না দিয়া।।
    মাতৃআজ্ঞা পেয়ে শান্ত হল পাঁচ ভাই।
    আজ্ঞা অনুসারে কার্য করিলেন তাই।।
    বড় অপমান হল পেয়াদা-গোমস্তা।
    বাবু বলে কাজ হল বড় অব্যবস্থা।।
    ভদ্রভাবে কৃষ্ণদাস কৈল সম্ভাষণ।
    রে আন এ হুকুম দিলে কি কারণ।।
    কি দোষেতে করি এ প্রজার অপমান।
    না দেখি পাতকী আর আমার সমান।।
    এখনে প্রজার ঠাই করি পরিহার।
    ধর্ম থাকে শোধ হলে এই ঋণধার।।
    এবে আর অন্য প্রজা মোরে না মানিবে।
    এই অপমানে সবে অবজ্ঞা করিবে।।
    ইহার বিধান কিবা করি বল তাই।
    গোমস্তা চলরে চল আগে দেশে যাই।।
    গোমস্তা ব্যবস্থাহীন প্রমাদ ঘটাল।
    রসরাজ কহে কাজ নহে কভু ভাল।।

    জমিদার কর্তৃক প্রজা উচ্ছন্ন বিবরণ।
    পয়ার।
    নিজন ভবনেতে এসে মন্ত্রীগণ লয়ে।
    মন্ত্রণা করিল সবে একত্র হইয়ে।।
    বড় জমিদার কহে মন্ত্রণা প্রবীণ।
    বন্দোবস্ত সময়েতে তাহারা জামিন।।
    যে সময়ে জমিদারী বন্দোবস্ত হল।
    শ্রেষ্ঠ প্রজা কৃষ্ণদাস জামিনাত ছিল।।
    প্রজা দমনের তরে এই পরামিশ।
    শরীক সাব্যস্ত করি করহ নালিশ।।
    শরীকের অংশ নেয় কর নাহি দেয়।
    কান্ট্রিবিউশনের নালিশ হল সায়।।
    তালুকের শরীক যে করিল সাব্যস্ত।
    কর নাহি দেয় বলে করিল দরখাস্ত।।
    কোনরূপ জবাব না দিলেন গোঁসাই।
    তের হাজারের ডিক্রী হইলেন দায়ী।।
    আদালতের পিয়ন আসিয়া বাটীপরে।
    অস্থাবর মাল বিক্রি করিলেন পরে।।
    মজুমদার নিজ নামে খরিদ করিল।
    অস্থাবর সম্পত্তি সকল লুটে নিল।।
    ঠাকুরেরা পাঁচ ভাই হল ফেরয়ার।
    বিষয় সম্পত্তি কিছু না রহিল আর।।
    সম্পত্তি লুঠিয়া নিল না হইল বাদী।
    সব ছাড়ি পাঁচ ভাই এল ওঢ়াকাঁদি।।
    প্রথম ভাদ্রেতে গোমস্তাকে মারিলেন।
    শেষ ভাদ্রে পাঁচ ভাই বাটী ত্যাজিলেন।।
    বিষয় সম্পত্তি যত সব দিল ছাড়ি।
    রামদিয়া থাকিলেন সেনদের বাড়ী।।
    সব লুঠে নিয়া নিল উত্তরের ঘর।
    করিল কাছারী ঘর কাছারীর পর।।
    সাত দিন পর সে কাছারী পুড়ে গেল।
    দুইগোলা ধান্য পুড়ে ভস্মীভূত হল।।
    সূর্যমণি মজুমদার পার্বতীচরণ।
    দুই ভাই করিলেন কথোপকথন।।
    কি অধর্ম করিলাম ঠাকুরের বাটী।
    মিথ্যা করি বিষয়াদি আনিলাম লুঠি।।
    প্রজার বাসের ঘর করিনু কাছারী।
    দাহ হয়ে গেল সব পাপ ছিল ভারি।।
    সূর্যমণি বলে ভাই পার্বতীচরণ।
    জমিদারী রবে নারে পাপ আচরণ।।
    পার্বতী বলিল দাদা এতযদি জান।
    ভিটায় প্রজারে তবে কয়ে বলে আন।।
    আশ্বিন কার্ত্তিক মার্গশীর্ষ পৌষমাস।
    রামদিয়া সেনদের বাটী কৈল বাস।।
    কখন কখন যাইতেন ওঢ়াকাঁদি।
    কখনও সফলাডাঙ্গা যাইতেন যদি।।
    দুই দিন কিম্বা একদিন মাত্র থাকি।
    আনিতেন কোন দ্রব্য মূল্যবান দেখি।।
    কতদিন পরে সেই রামদিয়া ছাড়ি।
    থাকিলেন ভজরাম চৌধুরীর বাড়ী।।
    চৌধুরীর বাসবাড়ী ওঢ়াকাঁদি গ্রাম।
    পরম বৈষ্ণব জপে রাধাকৃষ্ণ নাম।।
    প্রভুর মাতুল বংশ পঞ্চসহোদর।
    রামচাঁদ স্বরূপ যে অতি গুণাকর।।
    ঠাকুরেরা তার পিতৃস্বসার কুমার।
    কয় ভাই সেই বাটী বাঁধিলেন ঘর।।
    এক-আত্মা এক-প্রাণ তুল্য দশ ভাই।
    পিস্তাত মামতাত ভ্রাতা ভিন্ন ভেদ নাই।।
    বৈষ্ণবের শিরোমণি ছিল ভজরাম।
    প্রভুদের সঙ্গে সদা করে হরিনাম।।
    হরিকথা কৃষ্ণকথা হয়ে একতর।
    কোন কোন নিশি হত অই ভাবে ভোর।।
    চৌধুরীর বাটী ছিল পঞ্চ সহোদর।
    একা প্রভু আমভিটা বাঁধিলেন ঘর।।
    তথা আসি পারিষদগণের মিলন।
    রাত্রি দিবা করিতেন হরি-সংকীর্তন।।
    তার পূর্ব অংশে ছিল পোদ্দারের বাটী।
    চারি ভাই সেইখানে বাঁধিলেন ভিটি।।
    অই বাটী পূর্বকালে বিশ্বনাথ ছিল।
    সে জন বৈরাগী হয়ে বৃন্দাবনে গেল।।
    এভাবে করিল সবে ওঢ়াকাঁদি বাস।
    কবি বলে শুনিলে পাপের হয় নাশ।।

    প্রভুদের প্রতি জমিদারের বিনয়।
    পয়ার।
    স্থানত্যাগী ওঢ়াকাঁদি আছে পঞ্চ ভাই।
    জমিদারে লুঠে নিল বিত্ত কিছু নাই।।
    পার্বতীচরণ বাবু ওঢ়াকাঁদি গিয়া।
    প্রভুদের বলিলেন বিনয় করিয়া।।
    বহু স্তুতি মিনতি করিল বারেবার।
    সফলানগরে যেতে করি পরিহার।।
    কৃষ্ণদাস বলে শুন শুন মহাশয়।
    আর না হইব প্রজা তোমার ভিটায়।।
    তুমি রাজা নাহি তব উচিৎ বিচার।
    তোমার সমান অধার্মিক নাহি আর।।
    একবার যার সঙ্গে হয়েছে শত্রুতা।
    পুনঃ তার সঙ্গে কেহ না করে মিত্রতা।।
    নারীকে রাজাকে নাহি বিশ্বাস করিবে।
    চাণক্য পণ্ডিতবাক্য মিথ্যা নাহি হবে।।
    বিশেষ বিভীষণের প্রতিজ্ঞা রয়েছে
    সে বাক্য মোদের পক্ষে সকল ফলেছে।।
    জমিদার কহে তোমাদের টাকা দিব।
    সাতশত টাকা সুদসহ শোধ হব।।
    ধান্য গোলা ঘর গরু যত লুঠিয়াছি।
    যেহেতু আমরা বড় দুষ্কর্ম করেছি।।
    ইহকালে আমাদের হইল দুর্নাম
    আখেরে হইবে মন্দ বুঝে দেখিলাম।।
    জমাজমি তোমাদের ছিল যে সমস্ত।
    অন্যের সহিতে করি নাই বন্দোবস্ত।।
    যত লুঠ করিয়াছি অস্থাবর মাল।
    বুঝে দিব খাট পাট ঘটি বাটি থাল।।
    যা হবার হয়েছে আমি তজমিদার।
    তোমাদের নিকটেতে করি পরিহার।।
    পঞ্চ ভাই জমিদারের নিকট আসিয়া।
    কহিলেন ভূ-স্বামীকে বিনয় করিয়া।।
    আমাদের ক্রোধ আর নাহি তোমা প্রতি।
    এখানে আসিয়া মোরা হইয়াছি স্থিতি।।
    রাজা রামরত্ন রায় মহিমা অপার।
    হইয়াছি তার প্রজা করি অঙ্গীকার।।
    এখনে তাহাকে ত্যাগ করা বড় লাজ।
    বিনাদোষে ভিটা ছাড়া অধর্মের কাজ।।
    বিনা অপরাধে বল কেবা ছাড়ে বাপ।
    এখন তোমার ভিটাতে যাওয়া পাপ।।
    এত শুনি বাবু তবে ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস।
    নিজ ঘরে গেল ফিরে হইয়া নৈরাশ।।
    স্বচ্ছন্দে আনন্দ চিতে সুখে করে বাস।
    বড়কর্তা কৃষ্ণদাস করিল প্রকাশ।।
    হরি হরি বল ভাই নাম কর সার।
    তারক কহিছে হরি হবে কর্ণধার।।

    পঞ্চভাই পৃথগন্ন ও মুদ্রা বণ্টন।
    লঘু ত্রিপদী।
    পঞ্চ ভাই         এক ঠাই          বসিয়া হরিষে।
    হৃষ্ট মনে         ভ্রাতাগণে         কৃষ্ণদাস ভাষে।।
    কল্য দিনে        মম মনে         ভাবিয়াছি যাহা।
    হৃদি খুলে         সবেস্থলে         বলি ভাই তাহা।।
    দেখ ভাই         এক ভাই         করে ঠাকুরালী।
    পারে যদি        করে বিধি        মন্দ নাহি বলি।।
    যে সময়          ত্যাগ হয়         সফলানগরী।
    এর আগে         তে লাগে       প্রকাশ ঠাকুরী।।
    তাহা যত         অবগত           লিখিব সে লীলে
    শুন বার্তা         বড়কর্তা          এবে যা কহিলে।।
    লে বংশ       বহু অংশ         হইব পৃথক।
    সরাজিতে        এ কালেতে       হইব বণ্টক।।
    কর্মছাড়া          ঘরছাড়া                    য়েছি নাতক।
    যে অবস্থা         এ ব্যবস্থা         হওরে পৃথক।।
    চারি ভাই         শুনে তাই        বাক্য দিল সায়।
    বড়কর্তা          কহে বার্তা        বে লুঠ হয়।।
    মোর ঠাই         আছে ভাই        মুদ্রা দশ শত।
    দ্বিশতক          এক এক          ভাগ পরিমিত।

    পয়ার।
    মহাপ্রভু বলে ভাই আমার নিকটে।
    এইক্ষণে পঞ্চশত টাকা আছে বটে।।
    তৈলের দোকান করিয়াছি কিনা হাটে।
    এই টাকা লভ্য আছে আমার নিকটে।।
    এর এক এক শত পাবে একজন।
    এই টাকা সবে লহ করিয়া বণ্টন।।
    যার যার অংশ সেই সেই বুঝে নিল।
    তিনশত টাকা এক জনে অংশে পেল।।
    বিশ্বনাথ ভিটা পরে চারি সহোদর।
    মহাপ্রভু রল আম ভিটা বেঁধে ঘর।।
    জমিদার ফিরে গেল সফলানগরী।
    করিল বহু বিলাপ আসিয়া কাছারী।।
    কহিল নিষ্ঠুরবাণী তারা পঞ্চ ভাই।
    উচ্ছন্ন করেছি প্রজা ভালো করি নাই।।
    রাজার মিনতি আর বণ্টনের লীলা।
    শ্রবণে গৃহেতে লক্ষ্মী থাকেন অচলা।।
    শ্রীধাম শ্রীওঢ়াকাঁদি প্রভুর বিরাজ।
    রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

    ব্রজনাথের জীবন ত্যাগ।
    দীর্ঘ ত্রিপদী।
    প্রভু যবে রামদিয়া         ব্রজনাথ সঙ্গে গিয়া
    প্রভু সঙ্গে রঙ্গেতে বেড়ায়।
    পরে উড়িয়া নগরে        মহাপ্রভু বাস করে
    ব্রজনাথ সফলাডাঙ্গায়।।
    ফিরে এল জমিদার        প্রভু না আসিবে আর
    ওঢ়াকাঁদি হল বাসস্থান।
    শুনিয়া নিষ্ঠুর বাণী         বুকে করাঘাত হানি
    ব্রজনাথ ত্যজিল পরাণ।।
    গিয়া উত্তরের ঘরে         মধ্য চৌকি খাম্বা ধরে
    দাদা বলে ছাড়ে হুহুঙ্কার।
    দাঁড়ায়ে ত্যজিল তনু      বাহিরায় পরমাণু
    ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে যায় তার।।
    যেন শশী পল খসি       ব্রজনাথ জ্যোতি আসি
    হরিচাঁদ পদে লুকাইল
    তার ভ্রাতাগণ যত         করিল অগ্নি সংস্কৃত
    কবি কহে রবি ডুবে গেল।।


    No comments:

    Post a Comment

    শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত

    শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা

    শ্রীশ্রীহরিসঙ্গীত গান

    শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.