মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিৎ ২
রাজর্ষি গুরুচাঁদ ঠাকুরের ক্ষুরধার শিক্ষাবপ্লবের ফলে লক্ষ লক্ষ উচ্চ শিক্ষিত ফসল দিয়ে গোলা ভরেছে শত লক্ষ পরিবার। সেসব অর্থমূল্যে মূল্যায়িত শক্ষিত সমাজ এখন 'এলিট' শ্রেনীতে পৌছে গিয়ে ভুলে গেছেন হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরকে তাঁদের কাছে চালচুলাবিহীন সাদামাটা হরিভক্তরা তুচ্ছ-চাচ্ছিল্লে হরিব্বোলার দল নামে অভিহিত । কিন্তু বৈদিক অনুশাসনে সমৃদ্ধ বহিরাঙ্গ রঞ্জিত বাক্পটু সুকৌশলী বর্ণচোরা শোষক গুরুদের পদলেহন করে ওনারা ধন্য হন। নিজেদের পিতৃপরিচয় লুকিয়ে জাতে ওঠার সিড়ি খুঁজে বেড়ান। অথচ তপসিলী কোটায় সরকারি সুযোগ সুবিধার নিযার্সটুকু নির্লজ্জের মত চুষে খাচ্ছেন বংশ পরম্পরায়। পিছনে পড়ে থাকা ভাইবোনদের দিকে একবারও তাকান না । সামাজিক দায়িত্ব বোধ তাদের মধ্যে কদাচিৎ দেখা যায় মাত্র।
অথচ সরকারি চাকুরির কোটা তাদের জন্য প্রথম আদায় করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য, স্ব-জাতির জন্য। দূরদর্শী গুরুচাঁদ ঠাকুর বহুপূর্বে তাঁদের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন,-
"আজি যারা তপসিলী জাতি সাজিয়েছে।
শিক্ষা ছাড়া উন্নতি কি সম্ভব হয়েছে।।"
ঘৃণক আর দলকের নিষ্পেষণি ধর্মীয় ফতোয়ার বিরুদ্ধে, আর্ত-ক্ষুধার্ত বহুজনের পরিত্রাণের জন্য হরি-গুরুচাঁদের ছিল আপোষহীন মুক্তি সংগ্রাম। এই ইতিহাস যারা স্বীকার করেন না, তাদের কি মতুয়া বলা যায় ? তাঁরা কি বিবেকীবিধানে 'মানুষ' পদবাচ্যে পড়ে ? তারা কি সত্যদর্শী শিক্ষিত?
শুধু মতুয়া ঘরাণায় কথা ভাবলে ভুল হবে । তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পতিত বহুজন সমাজের ছেলেমেয়েদের যেমন শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল না তেমনি তাঁদের জন্য শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাও ছিল না । এমন কঠিক পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করে রাজর্ষি গুরুচাঁদ ঠাকুর শিক্ষার বন্ধ দুয়ার খুলে দিলেন । রাতারাতি তাঁর শিক্ষারূপ কল্পবৃক্ষ থেকে উঠে এলো শত সহস্র মাণিক রতন ।
এখন তাদের বংশধরেরা হরি-গুরুচাঁদকে চেনে না -চিনতে চায়ও না । এভাবেই সমাজে জন্ম হয় অকৃতজ্ঞ, বেইমান, বিভীষণদের । তাঁরা নিজেদের প্রতিপত্তি নিয়েই ব্যস্ত । গুরুচাঁদের মত সমাজ গড়ার কারিগর হয়ে বন্ধুত্বের বা স্ব-জাতি উন্নয়নী চেতনাদ্দীপ্ত ভ্রাতৃত্ববোধদিপনায় হাত পম্প্রসারিত করে না । অথচ গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রেম প্রক্ষালনী দরদী ভাষায় বারবার বললেন-
"জাতির উন্নতি লাগি, হও সবে স্বার্থত্যাগী
দিবারাত্র চিন্তা কর তাই
জাতি ধর্ম, জাতিমান, জাতি মোর ভগবান
জাতি ছাড়া অন্য চিন্তা নাই ।।"
আহা রে ! এমন দরদ দিয়ে আমার চিন্তা অতীত এবং বর্তমান কুচক্রী সমাজ ব্যবস্থায় আর কে করেছে ? শিক্ষিত সমাজ জীবন কেমন হওয়া উচিৎ , একটু ভেবে দেখবেন কি ?
গুরুচাঁদীয় শিক্ষা বিপ্লবের তীব্রতায় দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসা শিক্ষিত যুবকদের সরকারী চাকুরীর ব্যবস্থাও রাজর্ষি নিজ ক্ষমতায় করে দিলেন । তিনি বললেন-
"বিদ্যাহীন নর যেমন পশুর সমান ।
বিদ্যার আলোকে প্রাণে জ্বলে ধর্মজ্ঞান ।।
-----------------------------------
আইন সভায় যাও আমি বলি রাজা হও ।
ঘুচাও এ জাতির মনের ব্যথা ।।"
কিন্তু গুরুচাঁদ ঠাকুর পশুবৎ জীবন থেকে যাঁদের শিক্ষা, ধন, মান, যশ প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিলেন পরবর্তীকালে তাঁদের বংশধরেরা কেউ জাতির মনের ব্যথা ঘুচাতে এগিয়ে আসেনি । গুরুচাঁদের মনের ব্যথা গুরুতর হল নাকি ? প্রশ্ন থেকে যায়, বিদ্যার আলোকে তাঁদের অন্তরে মতুয়া ধর্মজ্ঞান জ্বলে উঠেছিল কি ? সমাজিক দায়বদ্ধতা, ঋণ জ্ঞানে ভাবা উচিৎ ছিল নাকি ?
আমরা সংঘব্দধ হতে পারি নাই । নিজেদের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা ছড়িয়ে দিয়েছি । আমরা ব্রাহ্মণবাদীর বর্ণাশ্রয়ী শিক্ষা নিতে ভালবাসি । তাই নিজেদের মধ্যে বিবাদ করি, হিংসাকরি,শিক্ষিত অশিক্ষিত বিভাজন করি । হরি-গুরুচাঁদীয় শিক্ষায় আছে প্রেম-জ্ঞান-সাম্য-স্বাধীনতার তত্ত্ব-দর্শন, চেতনা প্রদীপ্ত চৈতন্য শক্তির উষ্ণ-প্রস্রবণ । ভ্রাতৃপ্রেম, সঙ্গ এবং সংঘবদ্ধ এককিভুত মানব কল্যাণকামী সৃজনশীল প্রবহমান মহানশক্তির উৎস এই মতুয়াধর্ম । আমরা এই মহান ধর্মের মর্মকথা না বুঝে মুখপোড়া বাঁদরের মত এই ধর্মকে কালিমা লিপ্ত করে বলেছি "লোকায়ত ধর্ম" ।পক্ষান্তরে কল্পিত হিংসাশ্রয়ী দেব-দেবী আরাধনায় মেতে উঠে হারিয়ে ফেলেছি মাণীক রতন, ভুলে গেছি ভ্রাতৃপ্রেম, শিথিল করেছি স্ব-জাতি উন্নয়ন ।
গুরুত্ব দিয়ে গুরুর কথা না মেনে গরুবৎ বিশৃঙ্খল জীবন-যাপন করতে করতে আমার আর রাজা হওয়া হল না বরং বরণ করেছি প্রভু ভক্ত দাসত্বের জীবন ।
"ইতর পশুরা আছে বেঁছে যেই ভাবে
তোরাও তাদের মত কাজে কি স্বভাবে
এমন জীবনে বল বেঁচে কিবা ফল ।
আকারে মানুষ বটে পশু একদল ।।"
বহুস্থানে দলপতিদের মধ্যে ভেদাভেদ অর্থাৎ সহাবস্থানের আন্তরিক ফারাক লক্ষ্য করেছি । যেমন, মল্লিক বাবুর বাড়ির হরিসভায় 'রামের দল' গেলে শ্যামের দল যাবে না । কারণ, ওদের মধ্যে মতবিরোধ বা মনোমালিন্য । অথচ উভয় দল মতুয়া, 'হরিবোল' নামগানে আসর মাতায়, অশ্রু পাত করে, শতবার পদ ধূলি মাথায় নেয় । প্রশ্ন এখানে, আমরা কি মতুয়া না ভন্ড ? আমরা ভ্রাতৃপ্রেমে বিশ্বাসী না ভ্রাতৃবিচ্ছেদে বিশ্বাসী ? মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিৎ ভেবে দেখার সময় এসেছে । ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের সুখসুবিধার জন্য কৌশলী বর্ণ প্রকরণ করে মানুষকে শত শত জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত করে গোষ্ঠীদাঙ্গা বাঁধিয়ে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে । আর আমরা নিজেরা নিজেদের বিচ্ছন্ন করে কি উপকার করছি ? এই বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে দলিত বহুজন পরিত্রাতা হরি-গুরুচাঁদ বললেন,-
"যে জাতির দল নেই, সে জাতির বল নেই ।
যে জাতির রাজা নেই, সে জাতি তাজা নেই ।।
------------------------------------
ভিন্ন ভিন্ন দল কেহ কর না গোসাঁই ।
---------------------------------------
দুই ভাই এক ঠাই রহ মিলেমিশে ।
ভাই মেরে বল কেন মর হিংসা বিষে ।।"
স্বজনের অশ্রুসিক্ত সুর মুর্ছনায় আমাকে টেনে নিয়ে গেছে বাংলার অজানা প্রান্ত সীমায় । সর্বত্র লক্ষ্য করেছি ভেদাভেদহীন অকাতরে প্রণাম নিবেদনের দৃশ্য । যে দৃশ্য স্মরণ করায়, নবদিগন্তের নিষ্পাপ আত্মজাগরণী মন্ত্র "আত্ম দীপ ভব", হে সচ্চিদানন্দময় আনন্দ এসো মোর মন মন্দিরে ।
"প্রেমের নিগড়ে বাঁন্ধি, সবে করে কাঁদাকাঁদি
ভ্রাতৃভাব আনিল সংসারে ।"
কিন্তু পরক্ষণেই দেখি শিক্ষিত অশিক্ষিতের ভেদাভেদ । তাদের কথা, "নেহা ফড়া জানা বাবুরা আমাগো ফচন্দ করে না । ওয়াগো সাথে মেলামেশা নাই । ওনারা মতুয়া ধম্মে দীক্কা মানে না,গুরুকরণ মানে না, নক্কীপূজা কালীপূজা, দুগ্গা পূজা - কোনো পূজাই মানে না । ঠাহুর তো খ্যারোদের সাঁদ । উনি গুরু অয় ক্যাম্বালে । ওনারা বামুন ঠাহুরেও মানে না । য-ত্-ত্য সব নোম্বার শিক্ষিতের দল ।"--ইত্যাদি ।
এনারা যুক্তিতর্কের ধার ধারে না । বোঝালেও বুঝতে চান না, কারণ এই শিক্ষা তাঁরা তাঁদের দীক্ষাগুরুর কাছ থেকে পেয়েছে । তাঁরা দীক্ষাগুরুর ছবি ঠাকুরের আসনে রেখে ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে ডঙ্কা কাশী বাজিয়ে পূজা করেন । হরি-গুরুচাঁদ ঝুলে থাকে দেওয়ালে । এনাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, ঠাকুর ক্ষীরোদের সাঁই । তিনি থাকেন অমৃতলোকে । ধরাধামের লীলা শেষ করে আবার অমৃত লোকে চলে গেছেন । যিনি ক্ষীরোদসাঁই , স্বর্গধামে যাঁর বিশ্রামাগার । তিনি দীক্ষা দেবেন কমন করে । অতএব গুরুর মধ্য দিয়ে তাঁর পূজা পূর্ণতা পায় ।
গুরুচাঁদ ঠাকুর বজ্রকন্ঠে বললেন,-
"বিদ্যার অভাবে অন্ধ হয়ে সবে ।
অন্ধকারে আছো পড়ে ।।
জ্বেলে দাও আলো মোহ দূরে ফেলো ।
আঁধার ছুটিবে দূরে ।।
মতুয়া ধর্মে যেনারা গুরুগিরি করছেন তাদের সর্বনাশা ব্যাক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে সাবধান হওয়া উচিৎ । ভুল পথে ভক্তদের পরিচালিত করে মহান মতুয়া ধর্মের সর্বনাশ ডেকে আনবেন না । ব্রাহ্মণ্য ভেদনীতি পূর্ণ বৈদিক আচরণ ও গুরুবাদ বর্জন করে ভক্তদের হরি গুরুচাঁদীয় বেদ-বিধি তন্ত্র-মন্ত্র মুক্ত শিক্ষার আলোতে নিয়ে আসুন । তাতে আপনারাও বাঁচবেন, দেশ-জাতি পঙ্কিল বাতাবরণ থেকে স্ব-মহিমায় জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে । সাবধান । বেশী চালাচালি করতে গিয়ে চুলোচুলি না হয়ে যায় । বিদ্যার অভাবে ভক্তদের অন্ধ করে রেখেছেন কেন ? তাদের জীবনে জ্ঞানের আলো জ্বালালেন ন কেন ?গুরুচাঁদের নামে ধ্বনি দিচ্ছেন অথচ তাঁর শিক্ষা নীতি মানছেন না কেন ? গুরু-গোসাঁই-পাগল-দলপতিদের একটাই প্রশ্নকরি,- গুরুচাঁদ ঠাকুর উঠে যাবার পর(১৯৩৭-২০১৪)-৭৭ বৎসরে লেখাপড়া না শিখে তাঁদের প্রবর্তিত মহান মতুয়া ধর্মের সহজ-সরল নীতি বিধির অর্থ বুঝে অথবা না বুঝে ভক্তদের ভুল পথে পরিচালিত করে এসেছেন বলেই ভক্তজন মানসে নিগুড় ভ্রাতৃত্ববোধের বিবেকী দানা বাঁধতে পারে নাই ।
আপনাদের কাছে জানতে চাই
ক) গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা বিপ্লবের প্রথম সারির সৈনিক হয়েও নিজেরা শিক্ষিত (অন্তত সীমিত শিক্ষায়) হলেন না ? আর পর্যন্ত কোনো শিক্ষা আন্দোলন করেছেন কি ?
খ) আপনারা গুরুগিরি করছেন অথচ ঘরে ঘরে শিক্ষা বিপ্লব না করে ভক্তদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে কোন চাঁদের হাট মিলিয়েছেন ?
গ) মতুয়াধর্মে বেদ-বিধি কল্পিত মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আপনাদের উৎসাহে ঘরে ঘরে এসবের প্রচলন বিদ্যমান কেন ?
"হরিবোলা মোতোদের ভক্তি অকামনা ।
নাহি মানে তন্ত্র-মন্ত্র বজ্র উপাসনা ।।
বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
অন্য তন্ত্র-মন্ত্র এরা মাব পদে ঠেলে ।।
তন্ত্র-,মন্ত্র ভেক ঝোলা সব ধাঁ ধাঁ বাজী ।
পবিত্র চরিত্র থেকে হও কাজে কাজী ।।(" হঃ লীঃ)
ঘ) শিক্ষিত মতুয়ারা আপনাদের চক্ষুশূল কেন ? তাঁরা হরি-গুরুচাঁদের মূল আদর্শ অনুযায়ী সমাজ পরিবর্তনের পথে বিপ্লব ঘটাতে চায় বলেই কি আপনাদের ঘরে ঘরে অমাবস্যা নেমে আসার ভয়ে শিক্ষার বিরুদ্ধাচারণ করে ছলেছেন ?
আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আবেদন করছি, "অনুগ্রহ করে শিক্ষাকে মর্যাদা দিন, 'ভুল'কে 'ভুল' বলুন, সত্যকে জানুন এবং সত্য প্রচার করুন । গুরুচাঁদ ঠাকুরের মর্মস্পর্শী ইচ্ছা ও নির্দেশ,-
"অনুন্নত জাতি যদি বাঁচিবারে চাও
যাক প্রাণ সেও ভাল বিদ্যা শিখে লও ।"
ভক্তদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসুন ।
বহু শিক্ষিত মতুয়া পরিবারে ও জাঁকজমকপূর্ণ বেদাচারী আচার অনুষ্ঠান ও দেব-দেবী পূজা পার্বণের প্রাচুর্যতা লক্ষ্যনীয় । আপনারা ঠাকুরের প্রিয়জন হয়ে ঠোক্কর খাবেন কেন ? আপনারা মতুয়া ঘরাণার যথার্থ ক্রিয়াকাজে উদাহরণ হয়ে উঠলে পিছনের সবাই আপনাদের অনুকরণ ও অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই । শিক্ষা আনে চেতনা । চেতনা আনে বিপ্লব । এই বিপ্লবে আপনারাই সৈনিক । ঘরে ঘরে বিপ্লবের প্লাবন বইয়ে মতুয়া ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার গুরুদায়িত্ব আপনাদের । দলিত বহুজন সমাজের হরি-গুরুচাঁদের মত পরিত্রাতা পেয়েও যদি দৈব দাসত্বের অর্গল কল্পিত ঐশ্বরিক শৃঙ্খল ভেঙে শিক্ষিত সমাজ যদি এগিয়ে না আসে তবে এই জাতি কোনোদিন জাগবে না । তাঁরা বিবেক হীন চামচেয় পরিণত হবে । আসুন আমরা স্মরণ করি দলিত মহাজনের অমৃত বাণী-
"ব্রাহ্মণ্য ধর্মেতে পুষ্ট ভেদবুদ্ধি দ্বারা দুষ্ট ।
স্বার্থলোভী ব্রাহ্মণের দল ।।
---------------------
হিংসা দ্বেষ দন্দনীতি আনে ঘরে ঘরে ।
আর্য মল হিন্দু হল বীর্য গেল মরে ।।
----------------------
অন্ধজনে দিতে আলো অমানীরে মান ।
ওড়াকান্দি অবতীর্ণ হলো ভগবান ।।"
প্রশ্ন থেকে যায়, সহজ সরল দলিত বহুজন সমগোত্রীয়দের মধ্যে ভেদাভেদ দ্বন্দ্ব, বৈষম্য, হিংসা,দ্বেষ অতি সুক্ষ্মচাতুর্যে প্রবেশ করালো ব করাচ্ছে কারা ? তাকি একবার ভেবে দেখেছি ? আমার মনে হয়, আমরা যতটা মনোযোগ দিয়ে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র দর্শন অধ্যয়ন করি তার সিকি ভাগ মনোনিবেশ করি না শ্রীশ্রী হরিচাঁদ জ্ঞান-দর্শন তত্ত্বের উপর । যে দর্শন মতুয়াদের জীবনে এনেছে অপরা-বিদ্যা শিক্ষার তিরন্দাজী জোয়ার । আমরা ভুলে গেছি আমাদের পূর্বের অবস্থানের কথা ।
"অনুন্নত জাতি যত এ বঙ্গ মাঝারে ।
শিক্ষাশূন্য ছিল সবে ঘোর অন্ধকারে ।।"
সেই অন্ধকার অজ্ঞানতা থেকে আজকের শিক্ষা সভ্যতা, গাড়ি, বাড়ি, এক কথায় বিশ্ব এসেছে হাতের মুঠোয়- যার আঙ্গুলী লেহনে, তাঁকে স্মরণ ,মনন,তর্পণ করবো না ? তিনিই তো আমার জীবন প্রদীপ, একমাত্র আরাধ্য দেবতা । সেই মধুমাখা হরিনাম বেজে উঠুক আমার মনোবীণায় । এসো হে মনের মানুষ থাকো মোর হৃদয় জুড়ে । এসো হে মতুয়াধীশ তাপিত তৃষিত প্রাণে তুমি প্রাণারাম ।
বহুস্থানে লক্ষ্য করেছি, নানাস্থান থেকে আগত ভক্তেরা ডঙ্কা, কাশী, নিশান নিয়ে শ্রীহরি মহোৎসব আসরে মন্দির পরিক্রমা করে হরিনামের মাতাম দিয়ে ছড়িয়ে পড়েন আশে পাশের বাড়ি বা পাড়ায় । শুরু করেন আষাঢ়ে গল্প । নিন্দা মন্দের ধামা উবুড় করে জাহির করেন নিজের বুদ্ধিমত্তার কেরামতির অলীক ভক্তবিটেল চর্চা । অন্যান্য শ্রোতা বর্গ রসিয়ে কসিয়ে উপভোগ করেন । অপ্রচলিত বিশেষণ প্রয়োগ চলতে থাকে পরনিন্দা পরচর্চা এবং বক্তার বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানগরিমার পদাবলী । গপ্প দাদুর গালভরা গপ্পে মশগুল ভক্তরা হাসি ঠাট্টায় বুঁদ হয়ে যায় । ওদিকে হরিবাসর ফাঁকা । হরি ভক্তের চলন এমন হওয়া উচিৎ কি ? তাঁদের উচিত ছিল, শ্রী বিগ্রহের মন্দির পরিক্রমা ও মাতাম দিয়ে উপবেশন করে ধ্যানস্থ হওয়া । এতে শরীর মন শান্ত হয়, কূ-চিন্তা দূরে সরে যায় ।
মতুয়া ভক্তেরা পেটুক আখ্যা পেয়েছে । এনাদের অন্নপ্রসাদ গ্রহণ বা ভোজনের নির্দিষ্ট কোন সময় নেই । আমি নিজে দেখেছি এক বাড়ির হরিসভায় হরিভক্তরা ভোর ৪টার সময় গোগ্রাসে গরম গরম ডাল, ভাত তরকারি আহারে ব্যস্ত । রাত বারোটার পর সকাল ৬-৭টা পর্যন্ত এরূপ ভোজন করতে আমি বহু স্থানে দেখেছি । প্রত্যুষ কাল থেকে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যেকার সময়টুকু "ব্রাহ্ম মুহুর্ত" বলে । সাধারণত ভজন সাধন-পূজা পাঠ -প্রার্থনা ইত্যাদি করার এটাই উপযুক্ত সময় । অথচ এই ঊষাকালে ভক্তদের মচমচে শুকনো লঙ্কা ভাজা দিয়ে মহানন্দে পান্তা ভাত খেতে দেখেছি । অর্থাৎ ভোজন পর্বের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাধা নিষেধ মানামানির বালাই নেই । এটা স্বাস্থের পক্ষে হানিকর । অন্ন প্রসাদ গ্রহণের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত হওয়া শরীর স্বাস্থ্য ও সাধন ভজনের পক্ষে অতি উত্তম প্রবন্ধ । একে মেনে চলা উচিত বলে মনে করি । আবার অধিক ভোজন রোগের কারণ । অতএব পরিমিত আহার করা মহাজনের নির্দেশ । এতে দেহরথ ভালো থাকে । দীর্ঘ পরমায়ু সহ গতি সম্পন্ন হয় । সাধন ভজনে মনস্থির হয় । আপনি স্থির করুন, মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিত । (চলবে)
মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিৎ-১ -কালিদাস বারুরী
মতুয়া জীবন কেমআন হওয়া উচিৎ-১ -কালিদাস বারুরী
সংগৃহীত-মতুয়া দর্পণ ১৪বর্ষ, ৫৬ সংখ্যা,জানুয়ারী -মার্চ' ২০১৪ ,মাঘ-চৈত্র'১৪২০,২০২ হরিচাঁদাব্দ।
শ্রী শ্রী হরিচাঁদ কল্পতরু আগমনের দু-শোটি বছর পার করে এসেছি। এবার আত্ম সমীক্ষা। দীর্ঘ মতুয়া জীবনচক্রে ত্রুটি বিচ্যুতির চুলচেরা অঙ্ক কষে পাশ ফেলের ফলাফল জেনে নেবার সময় এসেছে । আলোচনা পর্বটি বিচক্ষণ দৃষ্টি দিয়ে হরি-গুরুচাঁদীয় বিপ্লবী শিক্ষা সামাজিক চরিত্রায়নে আমরা নিজেদেরকে কতটুকু সংগঠিত করতে পেরেছি তারই বিচার্য বিষয় ।
শ্রী শ্রী হরিচাঁদ অভেদাত্মা রাজর্ষি গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্ম দর্শন সমাজের সর্বস্তরের বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া বৃহৎ সংখ্যক মানুষের অগ্রগতির দিক ও দিশা তাতে কোন সন্দেহ নেই । মুষ্টিমেয় এক শ্রেনীর ধুরন্ধর স্বার্থান্বেষী মানুষের কুটকৌশলী দেবদোহায়ী বর্ণবাদদুষ্ট সামাজিক চাপ-শোষণ বঞ্চনা ও নির্যাতনে পদপিষ্ট হয়ে কাতারে কাতারে বঙ্গের মানুষ যেমন ধর্মান্তরিত হয়েছে তেমনই উদেশ্য প্রণোদিত হীনমন্য প্রবর্তকহীন হিন্দুধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে অগ্রগতির দিক ও দিশা তাতে কোন সন্দেহ নেই । মুষ্টিমেয় এক শ্রেণীর ধুরন্ধর স্বার্থান্বেষী মানুষের কূটকৌশলী দেবদোহায়ী বর্ণবাদদুষ্ট সামাজিক চাপ-শোষণ বঞ্চনা ও নির্যাতনে পদপিষ্ট হয়ে কাতারে কাতারে বঙ্গের মানুষ যেমন ধর্মান্তরিত হয়েছে তেমনই উদেশ্য প্রণোদিত হীনমন্য প্রবর্তকহীন হিন্দুধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার থেকে হাজার যোজন দূরে সরিয়ে রেখেছে ।
এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে পতিত পাবন শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাব(১৮১২-১৮৭৮) । শিক্ষা-জ্ঞান জীবে প্রেম, কর্ম-সাম্য এবং স্বাধীন আধ্যাত্মিক তত্ব ও দর্শন সংম্পৃত্ত "মতুয়া ধর্ম" উপহার দিলেন মৃতপ্রায় পতিত জাতিকে । ভেঙ্গে দিলেন ব্রাহ্মণ্য ষড়যান্ত্রিক মানুষ দলনীতি বিধি বিধান । যুগ পুরুষ হরিচাঁদ ভারতের নবীনতম ঐতিহাসিক ধর্ম ও কর্মের স্রষ্টা ও দ্রষ্টা । ঘৃণক আর দোলকদের ফতোয়াকে অগ্রাহ্য করে শুরু করলেন বহুজন মুক্তির আপোষহীন সংগ্রাম ।
তাঁর প্রবর্তিত প্রেমভক্তির পূর্ণ মায়া মমতা ভরা মত ও পথ 'মতুয়া ধর্মের' ছায়াছত্রতলে লক্ষ কোটি মানুষ পেল মুক্তি মোক্ষ, জীবনের বিকাশ-শক্তিতে চেতনা । মন্ত্র দিলেন নিজ নাম, 'হরিবোল' ।
ভক্তি ভাবের পশরা সাজিয়ে ভক্ত আর ভগবানের কথা লিখেছেন মহানন্দ হালদার এবং রসরাজ তারকচন্দ্র ।
"নাহি চেনে কোন দেবী, ঘট পট বিম্বা ছবি ।
জানে, মনে প্রাণে শুধু হরিচাদে ।।'
দীক্ষা নেই করিবে না তীর্থ পর্যটন ।
মুক্তি স্পৃহাশূন্য নেই সাধন ভজন ।
যাগ-যজ্ঞ তন্ত্র মন্ত্র দীক্ষা
কোন কিছুর নাহি প্রয়োজন ।
'হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বজন ।।"
ঠাকুরের বাণীর মধ্যে লুকিয়ে আছে আমার জীবনের দিক নির্ণয়ের নিশানা এবং ঠিকানা । যাঁর কৃপা ও করুণায় আমি শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিন প্রতিষ্ঠা পেয়েছি -সেই করুণার সাগর পরিত্রাতা হরিচাঁদ ভিন্ন আমার জীবনে অন্য কোন দেব দেবী , ঘট পট পূজা নেই, থাকতে পারে না । দীক্ষা নেই, তীর্থ পর্যটন নেই, যাগ-যজ্ঞ, তন্ত্র-মন্ত্র কিছুই নেই । একমাত্র হরিচাঁদই আমার উপাস্য ।
দীক্ষা-শিক্ষা মন্ত্রের অসারতার কথাও তিনি জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলেন-
"দীক্ষা মন্ত্র দেয় গুরু কর্ণে মুখ রাখি ।
হরিনাম মন্ত্র বিনা, সব মন্ত্র ফাঁকি ।।"
তা সত্ত্বেও মতুয়াদের মধ্যে দীক্ষা মন্ত্রের প্রচলন সর্বত্র দেখতে পাই । হরিচাঁদ দৃঢ়তার সঙ্গে ভক্তদের সাবধান করলেন এবং অভয় দিয়ে বললেন-
"হরিনাম মন্ত্র বিনা, সব মন্ত্র ফাঁকি।"
-অর্থাৎ হরিনাম-ই একমাত্র মহৌষধ-এর উপরে কোন ঔষধ নেই ।
তিনি পূর্ণ ভরসা দিয়ে বললেন-"আমার নাম অর্থাৎ 'হরিনাম' উচ্চারণে জীবনীয় শক্তি ও মুক্তি পাবে, আর কিছুর প্রয়োজন নাই । তা সত্ত্বেও অধিকাংশ মতুয়া পরিবারে বেশ ঘটা করে বিভিন্ন দেব-দেবী পূজার প্রচলন বিদ্যমান। পাশাপাশি কৃষ্ণনাম যজ্ঞ সহ অন্যান্য অনেক(ব্রাহ্মণ্যবাদী) গুরু পূজাও বিদ্যমান । কাউকে আঘাত দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার প্রশ্ন "বিশ্বাসের" । আমার'বিশ্বাস' যদি বহুমুখি হয় সে ক্ষেত্রে আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা-পূজা সবই বহুমুখি হবে এবং জনে জনে বিভক্ত হতে থাকবে । ফলে হরি পূজা পূর্ণতা লাভ করবে না । আমার 'বিশ্বাস' ও একমাত্র 'হরি'কেন্দ্রীক হবে না, আমার উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ একজনের উপরে আমি বিশ্বাস রাখতে পারছি না, ভুলে গেছি তিনিই আমার উদ্ধারকর্তা । বর্তমান প্রতিষ্টা তিনিই আমাকে দিয়েছেন । লক্ষী,সরস্বতী ,কালী, দুর্গা, রামকৃষ্ণ, অনুকুল, নিগমানন্দ, জগদানন্দ এঁনারা আমার উদ্ধারকর্তা নন । অতএব মতুয়াদের ভাবতে হবে, দ্বি-চারিতা হচ্ছে না তো ? যেখানে হরিঠাকুর নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে বলেন-
"পূর্ণ আমি হরিচাঁদ অপূর্ণের পিতা
সাধনা আমার কন্যা, আমি জন্মদাতা ।"
এতবড় প্রমাণ আর ভরসা থাকা সত্তেও মতুয়াদের বহুমুখি হওয়া মানেই তো হরিচাঁদে বিশ্বাসের অভাব । পক্ষান্তরে মনগড়া ব্যবসা বিত্তিক দেব-দেবী ও মূর্তি পূজায় অগাধ বিশ্বাস, এর অর্থ ব্রাহ্মণ্য নীতি -বিধি বিধানে আমার বেশী বিশ্বাস । অথচ এই বিধানের বি রুদ্ধাচারণ করে শ্রীহরি বললেন-
"তিন বেলা সন্ধ্যা কর আর সন্ধাহ্নিক ।
স্নান পূজা সন্ধাহ্নিক মোর নাহি ঠিক ।।
কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই ।
বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই ।।"
প্রশ্ন থেকে যায়-
আমি কি মতুয়া হতে পেরেছি ? আমি কি মতুয়া বিধি বিধান মেনে চলছি ? আমি কি একমাত্র শ্রীহরিতে বিশ্বাস রাখতে পেরেছি ? আমি কি পরিবারে হরি-গুরুচাদের ধর্ম-দর্শন প্রতিষ্টা করতে পেরেছি ? আমি কি হীনমন্য হিন্দু ধর্মের প্রতিবাদী 'মতুয়া' ধর্মাবলম্বী হতে পেরেছি ? আমি কি ভেদাভেদহীন "স্বয়ং সম্পুর্ণ মতুয়া ধর্মকে" জনমানসে প্রতিষ্ঠা কল্পে প্রচারে ও প্রসারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পেরেছি ?
যদি না পেরে থাকি তবে আর সময় নষ্ট না করে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যথার্থ মতুয়া হওয়ার লক্ষ্যে । এটা করতে পারলেই মুক্তি ও প্রাপ্তি । মহাশক্তি ও স্বস্তির পথ সুগম হবেই হবে ।
(২) (মতুয়া ধর্মে নারীর মর্যাদা ও অধিকার)
নারী মাত্রই মাতৃসমা । শ্রদ্ধা-ভক্তি ভালবাসা বা স্নেহের পাত্রী । মতুয়া ধর্মে ব্রাহ্মণ্য নীতি বিধি অনুযায়ী নারী জাতিকে মর্যাদাশীল পরনির্ভরশীল 'নরকের দ্বার' করে রাখা হয় নাই । নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, একথা মতুয়াধিপতি হরি গুরুচাঁদ ধর্মীয় ও মানবীয় ব্যাখ্যায় প্রথম জাতিকে প্রকাশ্যে দিবালোকের অক্সিজেন যোগান দিয়ে হরি-গুরুচাঁদ গড়লেন এক নয়া ইতিহাস । মায়েদের হাতে ধুপ-দ্বীপ-শঙ্খ দিয়ে, দিলেন পূজার অধিকার, ধর্মের অধিকার । নারী শিক্ষা বিদ্যালয় গড়ে, দিলেন শিক্ষার অধিকার । ঘটল মাতৃত্বের পূর্ণ বিকাশ । হরি-গুরুচাঁদ কল্পবৃক্ষে সোনার মানুষ, সাধু -সাধক, শিক্ষিত যুবক-যুবতীর ফসল ফলল । নারী জাতিকে মতুয়া কি নজরে দেখবেন তাও বলে দিলেন প্রাণারাম-
"পর নারী মাতৃজ্ঞানে দূরেতে থাকিবে ।
পরিহাস বাচালতা কভু না করিবে ।।
মেয়ে পুরুষেতে বসি একপাতে খায় ।
মেয়েদের এঁটো খায় পদধুলা লয় ।।
----------------------------
পুরুষ ঢলিয়া পড়ে মেয়েদের পায় ।
এক নারী ব্রহ্মচারী সৎচরিত্র রবে ।
------------------------------
নিজ নারী ভিন্ন অন্য নারীতে গমন ।
মহাপাপী ব্যভিচারী সেই একজন ।।
প্রশ্ন থেকে যায়,-
আমরা নারী জাতিকে মাতৃজ্ঞানে সম্মান করি তো ? আমি নিজ নারী সহ ব্রহ্মচারীর ন্যায়
সৎ চরিত্র বহন করছি তো ? আমি হরিনামামৃত পান করে দেহের ইন্দ্রিয় নিজের করায়াত্বে এনেছি তো ? আমি নারী মাত্রই 'মা' সম্বোধন করি তো ? মায়েদের সুখ-দুঃখের সমান ভাগীদার হই তো?
যদি না করে থাকি তবে আমার মতুয়া জীবন বৃথা ।মনে রাখবেন, হরি-গুরুচাঁদ প্রবর্তিত ধর্ম-দর্শন অতি উচ্চমার্গের । একে জীবনদায়ী ঔষধ মেনে গ্রহন করতে পারলে আমি নিশ্চিত করে বলছি, আপনার উন্নয়নের জন্য আপনাকে ভাবতে হবে না ।
"সর্বধর্ম লঙ্ঘি এবে করিলেন স্থূল ।
শুদ্ধ মানুষেতে আর্তি এই হয় মূল ।।"
(প্রেমবন্ধনের দৃঢ়তা কেন এত ঠুনকো ?)
শ্রীহরি বাসরে সরল অনাড়ম্বর জীবন সঞ্জাত 'হরিবোল' নামে ভাবোন্মোত্ত মতুয়াদের মমত্ত্বের ও সমত্বের প্রেমপ্রক্ষালনি অশ্রুসজল বাহু বেষ্টিত ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে দৃশ্যায়ন, আকর্ষণীয় প্রেমভক্তি ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় । কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলছি, এই ভাব ও সম্পর্ক স্ব-স্ব এলাকায় দেখা যায় না । সেখানে সগোত্রীয় হয়েও মেলামেশায় বহুলাংশে ফারাক । হিংসা-দ্বেষ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হাম বড়াই ভাবের অবাধ বিচরণ । চোখা চোখা বিশেষণ (গালাগালি) প্রয়োগে পারদর্শিতা যথেষ্ট । বাহু যুদ্ধেও পিছিয়ে নাই । মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকে , প্রতিশোধ স্পৃহা ঘুম কেড়ে নেয় । পড়শিদের ভীতি প্রদর্শনে ভীত নয় । অথচ এরাই হরিবাসরে হরিনামের অমৃত ভাব ও প্রেমের বন্যা বইয়ে দেয় । পদধুলি সংগ্রহে কাড়াকাড়ি হয় । কোলাকুলি অশ্রুবন্যায় হরিবাসর প্রেমের সাগর হয়ে ওঠে । ভাবি এই বন্ধন চিরস্থায়ী নয় কেন ? এই প্রেম সর্বত্র সর্বদা সমানভাবে সংঘবদ্ধ হয় না কেন ?যেখানে দয়াধীশ ভবিষ্যৎ বাণী দিয়েছেন-
"সর্বজাতি সমন্বয় হবে তাঁর মতে ।
ভাই ভাই হয়ে সব চলিবে সে পথে ।।"
(গুরুগিরি)
অনেকে গুরুগিরি করেন । গুরুগিরি ব্যবসা করেন, সংসার চালান, দীক্ষা দেন, শিষ্য তৈরীতে পারদর্শিতা দেখান । যে সাধন- ভজন অধ্যাবসায় দক্ষতা থাকা দরকার-ইদানিং গুরুদের মধ্যে তেমন উপযুক্ত একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না । গোপাল সাধু, তারক গোঁসাই, লোচন,অশ্বিনী, নাটু, ব্রজনাথ ডাঃ তারিনী বলের মতো সাধক পুরুষ আছে কি ? এঁনারা জীবন দিয়ে জাতির উন্নতির জন্য গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গেছেন । বর্তমান গুরুকূল পরিবার পোষা গুরুগিরি ছেড়ে "হাতে কাম মুখে নাম" করলে উভয়ের মঙ্গল । নচেৎ মহান মতুয়া ধর্ম অদূর ভবিষ্যতে বহুধা বিভক্ত হবে সন্দেহ নেই । নিছক ব্যক্তি স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সমগ্র জাতির কল্যাণ চিন্তা করাই শ্রেষ্ঠ পথ ।
"জাতির উন্নতি লাগি, হও সবে স্বার্থত্যাগি,
জাতি ধর্ম জাতি মান, জাতি মোর ভগবান,
জাতি ছাড়া অন্য চিন্তা নাই ।"
বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই আত্মসচেতনী উদার আহ্বান বাণী । তিনি ছত্রিশটি বিচ্ছিন্ন জাতিকে একত্রিত করে যে পথ ও পাথেয় দিয়ে মতুয়া ধর্মকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরেছেন,নিছক ব্যক্তি স্বার্থে এই মহান ধর্মের সর্বনাশ ডেকে আনবেন না । ঠাকুরের আসনে ঠাকুরকেই বসান । গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হৃদয় মন্দির হরি গুরুকে প্রতিষ্ঠা করুন। তাঁর নাম মনন করুন তাতে নিজের দেশ ও জাতির কল্যাণ হবে তো হবেই । গুরুর আসনে ভুল করে গরুকে বসাবেন না । গুরু-গুরুই হয় আর গরু-গরুই হয় । গরু কখনো গুরু হতে পারে না ।
"মতুয়ার এক গুরু ভিন্ন গুরু নাই ।
ভিন্ন ভিন্ন দল কেহ করো না গোসাঁই ।।"
পাগল দলপতিদের যত্র-তত্র ছুতো-নাতায় আস্ফালন করা বা ক্রোধ প্রদর্শন শোভনীয় নয় । 'বিজ্ঞতা'প্রদর্শন অপেক্ষা 'বিজ্ঞ' হয়ে ওঠা শ্রেষ্ঠ পথ । আমার কি করা উচিৎ, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে শুভ বিবেকী সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে ।
(৩)(মতুয়া পদ্ধতিতে (শ্রাদ্ধ নয়) শ্রদ্ধা অনুষ্ঠান, বিবাহ ও ঠাকুর পূজার প্রচলন করা ।)
বৈশ্যসাহা কন্যার সঙ্গে মুসলমান যুবক তিনকড়ি মিঞাঁর বিয়ে দিয়ে সেদিন গুরুচাঁদ ঠাকুর যে সেতু বন্ধন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদকে পদদলিত করে বিজয় নিশান উড়িয়ে আমাদের বোঝালেন, "তোমরাও মতুয়া ধর্ম-দর্শন মেনে নিজেদের ক্রিয়াকাজ নিজেরাই সম্পন্ন কর"। অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষায় রচিত দুর্বোধ্য পদ্ধতি বিসর্জন দিয়ে শুদ্ধ সহজ বাংলা ভাষায় রচিত (শ্রাদ্ধ নয়) শ্রদ্ধা অনুষ্ঠান, বিবাহ ও ঠাকুর পূজা ইত্যাদি ক্রিয়াকাজ প্রতি ঘরে ঘরে তোমরা চালু কর ।
অথচ এই কাজটিও আমরা সঠিক ভাবে সর্বত্র চালু করতে পারিনি বরং এখনও অধিকাংশ মতুয়া পরিবার ব্রাহ্মণ্য নীতিতেই বিশ্বাসী । আমরা অনেক গল্পভরা কথা বলি কিন্তু স্বীকার করতে হবে,গুরুচাঁদ ঠাকুরের যাবতীয় নির্দেশের মধ্যে একটি নির্দেশও আজ পর্যন্ত আমরা সঠিক ভাবে পালন করতে পারিনি ।
(ঠাকুর নির্দেশিত মত-পথ ও আদর্শকে কিভাবে পালন করতে হবে । )
প্রসঙ্গক্রমে গুরুচাঁদ ঠাকুরের একটি নির্দেশ বাণী
যেমন-
"সবাকারে বলি আমি যদি মানো মোরে ।
অবিদ্বান পুত্র যেন নাহি থাকে ঘরে ।।"
প্রশ্ন থেকে যায়-
আমরা কি গুরুচাঁদ ঠাকুরকে মান্য করতে পেরেছি ? আমরা কি গুরুচাঁদ ঠাকুরকে অন্তর দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছি ? আমরা কি গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশ মত চলছি ? আমরা কি তাঁর দেওয়া রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি সংস্কার নীতি অর্থনীতি রূপায়ণ করার জন্য নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পেরেছি ?
যদি গুরুচাঁদের গুরুভার বহন না করে থাকি তবে আমি মতুয়া হলাম কি করে ? একটাই সমাধান, আসুন আমরা প্রথমে মতুয়া হই, তার পর মেতে উঠি হরি-গুরুচাঁদের প্রদর্শিত এবং নির্দেশিত কর্মকান্ড পরিপূরণে ও রূপায়ণে ।
পরিচ্ছন্নতা মতুয়া ধর্মের একটি বিশেষ অঙ্গ । বাহ্য ও অন্তরঙ্গ শারীরিক পরিচ্ছন্নতা সহ পরিপাটি বসন ভূষণ ব্যবহার পবিত্রতার পরিচায়ক । দেহশ্রীকারক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বেশভূষা পরিধান করা মতুয়াধিরাজ গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশ । এই নির্দেশ পালনের মধ্যে মনে প্রাণে শুদ্ধ নিঃষ্কলুষ শ্রী মন্ডিত ভক্তের ভক্তিযুক্ত আত্মনিবেদন আত্মপ্রসাদ লাভ করে সন্দেহ নাই । বহুক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতার অভাব আছে । গৃহাদি দেবতার মন্দির ভেবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা উচিৎ ।
"ধন চাই বসন ভূষণ চাই, হতে চাই জজ ম্যাজিস্ট্রেট ।
----------------------------------------
সবখানে থাকা চাই, তা ভিন্ন উপায় নাই ।
রাজ বেশে সাজ রাজ সাজে ।।
------------------
গৃহে কিংবা শ্রীহরি কীর্তনে ।
পরিচ্ছন্ন বেশ -ভূষা পর যতনে ।।
আপন গৃহকে কর শ্রীলক্ষ্মী আগার ।
ধর্ম-কর্ম মিলেমিশে ভব পারাবার ।।"
হরিকীর্তন আসরে আমরা নির্দিধায় পান-তামাক-বিড়ি সেবন করি । সম্মুখে শ্রীহরির প্রতিকৃতি বা ছবি থাকে । বিড়ির ধুম্ররাশি ঘুরপাক খেতে খেতে শ্রীহরির অঙ্গে মিশে যায় । আমার হুঁশ নাই । এটা কি ঠিক ? শ্রীহরি-গুরুচাঁদ যদি আমার জীবন দেবতা হন তবে তাঁদের সামনে ধুম পান করা লজ্জাস্কর এবং নিন্দনীয় নয় কি ? ঠাকুরকে যদি ছবি বানিয়ে ফেলি বা ছবি ভাবি তবে আমার কিছু বলার নেই । তবে তিনি অজর অমর অক্ষয় যুগপ্রহরী, আমার চতুর্দিকে বিরাজ করছেন-এমনটি ভাবলে তিনি আমার কাছে জীবন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে আমাকে সর্বদা রক্ষা করবেন সন্দেহ নাই । তদুপরি ধুমপানে আসরের পবিত্রতা নষ্ট হয় এবং অ-ধুমপায়ীদের অসহ্য কষ্ট হয় । তাঁরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন । অতএব নেশা পরিত্যাগ করাই বিধেয় ।
Social Counter
Comments