শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.
১২ মধ্যখণ্ডঃ সপ্তম তরঙ্গ (১ম অংশ) - মতুয়ার বার্তা

শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.

  • Breaking News

    হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা

    ➤ ১. সদা সত্য কথা বলবে। ➤ ২. পিতা-মাতাকে দেবজ্ঞানে ভক্তি করবে।➤ ৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে। ➤ ৪. জগতকে ভালোবাসবে।➤ ৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে। ➤ ৬. জাতিভেদ করবে না। ➤ ৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। ➤ ৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে। ➤ ৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে। ➤ ১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না। ➤ ১১. ষড়রিপু বশে রাখবে। ➤ ১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।

    ১২ মধ্যখণ্ডঃ সপ্তম তরঙ্গ (১ম অংশ)


                     মধ্যখণ্ডঃ সপ্তম তরঙ্গ (১ম অংশ)

    মধ্যখণ্ড
    সপ্তম তরঙ্গ
    বন্দনা
    জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস
    জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস
    ।।
    জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর

    পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার
    ।।
    জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন

    জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
    জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়
    জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
    জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ
    নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।

    পাগলের বানরপ্রধান মূর্তি ধারণ ও গঙ্গা দর্শন
    পয়ার
    পুনর্বার একদিন গঙ্গাচর্ণা যেতে।
    চলিলেন পাগলাই করিতে করিতে।।
    অক্রুর বিশ্বাস রামকুমার বিশ্বাস।
    দুই জনে মিলে এল পাগলের পাশ।।
    পাগল দেখিয়া বড় হৈল মন প্রীত।
    উভয় উভয় পক্ষ প্রেমে পুলকিত।।
    তিন জন একসঙ্গে যাইবে বলিয়া।
    একত্রে হইল পার পাতগাতী গিয়া।।
    পাগল নামিতে তীরে দেয় এক লম্ফ।
    নদী জল উথলিল যেন ভূমিকম্প।।
    কিনারে আসিতে বাকী দশ বার নল।
    গভীর ভাগণ কূল স্রোত পাক জল।।
    জল হতে চারি হাত উর্দ্ধেতে পাহাড়ি।
    পাড়ির উপরে পড়ে বায়ু ভরে উড়ি।।
    দেখিয়া সকল লোক মানিল বিস্ময়।
    নাবিক কহিছে ইনি মনুষ্যত নয়।।
    গোস্বামী দৌড়িয়া গেল গঙ্গাচর্ণা গ্রামে।
    কার্তিকের গৃহেতে মাতিল হরিনামে।।
    অক্রুর রামকুমার আইল পশ্চাতে।
    শম্ভুনাথ ঘরে বসিলেন একত্রেতে।।
    বলে ওহে শম্ভুনাথ পাগল কোথায়।
    বার্তা শুনি শম্ভুনাথ অন্বেষণে যায়।।
    এদিকে পাগল ভাবিছেন মনে মনে।
    ভাল হত কার্ত্তিক আনিলে সে দুজনে।।
    মন জানি ততক্ষণ কার্ত্তিক চলিল।
    তাড়াতাড়ি করি দোঁহে ডাকিয়া আনিল।।
    তাঁহারা আসিয়া রাইচরণের ঘরে।
    প্রেমানন্দে মেতে দোঁহে হরিনাম করে।।
    পাগল করিছে নাম তাহা শুনিতেছে।
    পাগলের সঙ্গে কার্তিকের ভার্যা আছে।
    মৃদুস্বরে হরি বলে পাগলের সঙ্গে।
    কার্ত্তিক ভাসিয়া যায় প্রেমের তরঙ্গে।।
    না এল বিশ্বাসদ্বয় পাগল ছুটিল।
    গিয়া রাইচরণের ঘরেতে উঠিল।।
    দুই বিশ্বাসেরে আনি মদনের ঘরে।
    পাগল বাহিরে গিয়া হরিনাম করে।।
    (এক শব্দ নাই) দুই পুত্র চাঁদ ধতুরাম।
    ধতুরামের পুত্রের ঠাকুরদাস নাম।।
    তার পুত্র রামনিধি ভকত সুজন।
    অতি শুদ্ধ মতি তার তিনটি নন্দন।।
    জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহন মধ্যম শ্রীমদন।
    সব ছোট বনমালী বৈষ্ণব লক্ষণ।।
    মদনের ঘরে বসি আর আর লোক।
    গৃহের বাহিরে ঘোরে গোস্বামী গোলোক।
    মদনের ঘরে রাইচরণের ঘরে।
    বায়ু বেগে দুই বাড়ী যায় আসে ঘুরে।।
    ঘর ঘেরি বাড়ী ঘেরি দেয় ঘন পাক।
    চক্রাকারে ঘুরে যেন কুম্ভকার চাক।।
    তাহাতে লোকের ভিড় হইল অধিক
    মাঝে মাঝে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে কার্ত্তিক।
    কার্তিকের বাড়ী বাল্য বৃদ্ধ যুবা যত।
    সব নাম সংকীর্তনে হয়েছে উন্মত্ত।।
    রাইচরণের বাড়ী যতলোক ছিল।
    দিশেহারা মাতোয়ারা কীর্তনে মাতিল।।
    রজনী মহিমা বনমালী প্রামাণিক।
    বৃন্দাবন নিবারণ প্রেমেতে প্রেমিক।
    রাইচরণের ঘরে মদনের ঘরে।
    বহুলোক মেশামেশি ভাসে প্রেমনীরে।।
    সবে মিলে পাগলের বিক্রম  দেখিয়া।
    ভ্রান্তিতে গিয়াছে সবে সংজ্ঞা হারাইয়া।।
    সিংহ নাদ সিংহবীর্য গর্জিছে পাগল।
    জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।।
    মদনের ভগিনী মহিমা নাম ধরে।
    তার কণ্ঠস্বর যেন অমৃত নিক্ষরে।
    পাগল উন্মত্ত হয়ে করে হরিনাম।
    বেড়াপাক কীর্তন যেমন ক্ষেত্রধাম।।
    দলে দলে মহাপ্রভু নাচিত যেমন।
    তেমনি গোলোকচন্দ্র করিছে ভ্রমণ।।
    এক এক বার যবে দিতেছেন লম্ফ।
    তিন চারি বাড়ী কাঁপে যেন ভূমিকম্প।।
    পাগলের প্রতি কার্তিকের বড় আর্তি।
    দৈবেতে পাগলের দেখিল কপি মূর্তি।।
    লম্ফ দিয়া দশ বার হাত উর্দ্ধ হয়।
    লাঙ্গুল ঠেকিল গিয়া কার্তিকের গায়।।
    শূন্য মার্গে রাম রাম রাম রাম বলে।
    অতি ভীমকায়, লম্বা পুচ্ছ, পিছে ঝুলে।।
    অক্রুর রামকুমার ডেকেছে কার্ত্তিক।
    কি দেখিনু কি হইল নাহি পাই ঠিক।।
    তোমরা জানহ শাস্ত্রগ্রন্থ রামায়ণ।
    দেখ এসে পাগলের লক্ষণ কেমন।।
    ঘরে থাক কেন সবে বাহিরে এসনা।
    একা আমি দেখিলাম তোরা দেখিলি না।।
    অক্রুর রামকুমার বাহিরে আসিল।
    কপি মূর্তি দেখি তথা মূর্ছিত হইল।।
    দেখে মোহপ্রাপ্ত হৈলি কহিছে পাগল।
    রে তুলে বলে তোরা বল হরিবোল।।
    শম্ভুনাথে বলে কি দেখিলি শম্ভুনাথ
    শম্ভু কহে লেজ দেখি দশ বার হাত।।
    পাগল বলিছে কারু নাহি দিব ফাঁকি।
    দেখাইব যাহা আছে দেখাবার বাকী।।
    যা গ্রামের শ্যামা রামা সবে ডেকে আন।
    সকলে দেখুক আমি বানর প্রধান।।
    চূড়ামণি পুত্র রামমোহন সুমতি।
    ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত মাতা তোলাবতী।।
    পাগল কহিছে ডেকে সবে তোরা আয়।
    হইয়াছে বেশী বেলা স্নানের সময়।।
    চলিল সকল ভক্ত হরিধ্বনি দিয়ে।
    পাগলের জয় জয় সকলে বলিয়ে।।
    অগ্রে চলিলেন সব মতুয়ারগণ।
    আর সব পিছে চলে করি সংকীর্তন।।
    পাছের লোকের সঙ্গে চলিল গোঁসাই।
    ক্ষণে দেখে সর্ব অগ্রে করে পাগলাই।।
    হরিনাম ধ্বনি উঠে গগন মণ্ডলে।
    পাগল বলিল সবে নাম গিয়া জলে।।
    জলকেলি করিতে সকলে এলি জুটে
    সবে নাম ঘাটে আমি যাইব অঘাটে।।
    পাগল পশ্চিম দিকে যায় ঘাট ছাড়ি।
    শম্ভুনাথ সাথে সাথে যায় দৌড়াদৌড়ি।।
    শম্ভুনাথ দৌড়ে যায় দেখিয়া কার্ত্তিক।
    পিছে পিছে দৌড়ে যায় হহিয়া বিদিক।।
    অক্রুর রামকুমার তাহা দেখি ধায়।
    পাগল মারিল লম্ফ লেজ দেখা যায়।।
    লম্ফ দিয়া পাগল জলের মধ্যে পড়ি।
    জল ফেলাফেলি করে আছাড়ী পাছাড়ী।।
    পূর্বঘাটে সকলে করিছে জলকেলি।
    পশ্চিমে পাগল করে জল ফেলাফেলি।।
    জল ছিটাছিটি যেন ঘন মেঘ বৃষ্টি।
    পাগলের প্রতি কার নাহি চলে দৃষ্টি।।
    হেনকালে মধ্যে জলে মকর উঠিল।
    পাগল মকর ধরি মাথায় লইল।।
    জলের মধ্যেতে দৃষ্টি করে চারিজনে।
    পাগল জলের পরে বসি যোগাসনে।।
    জল হতে উঠে জল বৃষ্টি যেন হয়।
    কেবা বরিষণ করে কে জল উঠায়।।
    মকর মস্তকে ছিল পড়িল জলেতে।
    পাগল বসিল গিয়া মকর পৃষ্ঠেতে।।
    দেখে পাগলের নাই পূর্বের আকৃতি।
    মকরের পৃষ্ঠে বসে শ্বেত বর্ণা সতী।
    পাগল জল তরঙ্গে ভাসিয়া বেড়ায়।
    ভাসিতে ভাসিতে শেষে এল কিনারায়।।
    মাত্র এক মকর ভাসিয়া রহে জলে।
    বৃষ্টি ধারা অনুক্রমে মকর ডুবিলে।।
    দেখিতে দেখিতে পুনঃ মকর ভাসিল।
    গঙ্গা এসে মকরের পৃষ্ঠেতে বসিল।।
    দেখিয়া পাগলচাঁদ ধাইয়া চলিল।
    গঙ্গার চরণ ধরি মস্তকে করিল।।
    গঙ্গাদেবী ধরিয়া পাগলে করে কোলে।
    সিংহনাদে পাগল ডেকেছে মা মা বলে।।
    পাগল বলেন করি পদে জলকেলি।
    অপরাধ ক্ষম মাতা নিজ পুত্র বলি।।
    গঙ্গা বলে তুমি হরিচাঁদ প্রিয় পাত্র।
    আমি তব অঙ্গ স্পর্শে হইনু পবিত্র।।
    পূর্বদিকে ঘাটে সব লোকে করে দৃষ্টি।
    তারা বলে ওই ঘাটে হয়ে গেল বৃষ্টি।।
    পাগল সাঁতার দিয়ে উঠিলেন কূলে।
    অচেতন চারিজনে ধরে ধরে তুলে।।
    ঘাটের উত্তরে গ্রাম দক্ষিণেতে গোগ।
    পাগল করিল তথা গঙ্গাস্নান যোগ।।
    তথা স্নানে পূর্ণ হয় সব মনস্কাম।
    গঙ্গাতুল্য শুদ্ধ ঘাট বেলে ঘাট নাম।।
    পাগলের যোগে গোগে গঙ্গা বারমাস।
    অদ্যাপি সে কাণ্ড লোক মুখেতে প্রকাশ।।
    পাগলের জলকেলি দেখা গেল লেজ।
    রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

    ভক্ত গোলোক কীর্তনিয়ার ঠাকুরালী
    পয়ার
    ওঢ়াকাঁদি গোলোক কীর্তুনে আসে যায়।
    ঐকান্তিক ভক্তি হরি ঠাকুরের পায়।।
    একদা শ্রীহরি বসি পুষ্করিণী তীরে।
    গোলোক বসিল গিয়া ঠাকুর গোচরে।।
    ঠাকুর গোলোকে কহে কি কাজ করিলি।
    গান করি চিরদিন লোকেরে শুনালি।।
    এমন মধুর রাম নাম শুনাইয়ে।
    বিলালী অমূল্য ধন অর্থ লোভী হয়ে।।
    যে ধনের মূল্য নাই তাহাই বেচিলি।
    অমূল্য ধনের মূল্য কিছুই না পাইলি।।
    কাঁদিয়ে কীর্তুনে কহে ঠাকুরের ঠাই।
    আজ্ঞা কর কি কার্য করিব শুনি তাই।।
    ঠাকুর কহেন বাছা ধর্ম কর্ম সার।
    সর্ব ধর্ম হতে শ্রেষ্ঠ পর উপকার।।
    কীর্তনিয়া বলে হে তারকব্রহ্ম হরি।
    আমি কি পরের ভাল করিবারে পারি।।
    মহাপ্রভু বলে বাছা বলি যে তোমায়।
    কেহ যদি ঠেকে কোন আদি ব্যাধি দায়।।
    ওঢ়াকাঁদি আসিতে যে করয় মনন।
    এ পর্যন্ত আসিতে দিও না বাছাধন।।
    আমাকে ভাবিয়া যাহা তোর মনে আসে।
    তাহাই বলিয়া দিস মনের হরিষে।।
    তাহাতে লোকের হবে ব্যাধি প্রতিকার।
    ইহাতে হইবে তোর পর উপকার।।
    যে রোগের বৃদ্ধি যাতে তাই খেতে দিস।
    হরিনামে মানসিক করিতে বলিস।।
    রোগমুক্ত হলে সেই মানসার কড়ি।
    আমাকে আনিয়ে দিস ওঢ়াকাঁদি বাড়ী।।
    রোগাভক্তি কলিতে হয়েছে বড় ব্যক্ত
    রোগমুক্ত হবে সবে হবে হরিভক্ত।।
    কহিয়া সারিও ব্যাধি ভাবিয়া আমারে।
    অর্থ দণ্ডে পাপদণ্ড নামে পাপ হরে।।
    নিজে না হইও লোভী অর্থের উপর।
    তাহা হলে করা হবে পর উপকার।।
    শুনিয়া গোলোক বড় হরষিত হয়ে।
    সারাতে লাগিল ব্যাধি হরিনাম দিয়ে।।
    অনেক লোকের ব্যাধি হইয়া মোচন
    হরিভক্ত হয়ে করে হরি সংকীর্তন।।
    রাউৎখামার আর মল্লকাঁদি গ্রাম।
    চারিদিকে সবলোকে করে হরিনাম।।
    এইরূপ ভক্ত সব হইতে হইতে।
    প্রকাশ হইল ধর্ম দক্ষিণ দেশেতে।।
    বর্ণী বাশুড়িয়া দলোগুণী আটজুড়ি।
    পাতগাতী কলাতলা গ্রাম বড়বাড়ী।।
    গঙ্গাচর্ণা গ্রামমাঝে শম্ভুনাথ বাড়ী।
    প্রহরাষ্ট থাকে তথা যেন বাসা বাড়ী।।
    তাহাতে অনেক লোক হইল বিমনা
    অই বাড়ী ছেড়ে কেন গোঁসাই লড়ে না।।
    চারিযুগে সৎকার্য আছে বিড়ম্বন।
    অনেক ভাবেতে ফিরে অনেকের মন।।
    ঠাকুর নিকটে সবে নানাভাবে কয়।
    শম্ভুনাথ ওঢ়াকাঁদি হইল উদয়।।
    ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে গোলোক কি করে।
    বিশ্বাস কি অবিশ্বাস তাহার উপরে।।
    শম্ভু কহে বিশ্বাস করেছি আমি যারে।
    আর নাহি অবিশ্বাস করিব তাহারে।।
    ঠাকুর কহেন আর নাহি অবিশ্বাস।
    কেটে গেছে বাছা তোর কর্মবন্ধ ফাঁস।।
    ঠাকুর বলেন মোরে যে দিয়াছে মন।
    মোর মনে দোষ কার্য করে না কখন।।
    প্রভু তবে পাগল গোলোকচাঁদে কয়।
    যা দেখি গোলোক তুই গঙ্গাচর্ণা গায়।।
    নিজামকাঁদির ভক্ত গোবিন্দ নামেতে।
    সদাকাল থাকে সেই গোলোকের সাথে।।
    তাহার নিকট মহানন্দ জিজ্ঞাসিল।
    ইতি উতি ভাবে কত অনেক কহিল।।
    মহানন্দ কহে তাহা গোস্বামী পাগলে।
    পাগল কহেন তবে মহানন্দ স্থলে।।
    আমাকে যাইতে সেই গঙ্গাচর্ণা গ্রাম।
    শ্রীমুখে বলেছে প্রভু থাকিয়া শ্রীধাম।।
    সেই হতে যাব যাব ভাবিতেছি মনে।
    না যাইয়া অপরাধী হৈনু প্রভু স্থানে।।
    এই আমি চলিলাম ঠাকুর ভাবিয়া।
    যা কর তা কর মম সঙ্গেতে থাকিয়া।।
    গোস্বামী চলিল তবে দিয়া হরিবোল।
    শম্ভুনাথ গৃহে গিয়া বসিল পাগল।।
    গোস্বামীর শব্দ শুনি সে রাইচরণ।
    প্রণমিয়া বলে চল আমার ভবন।।
    শম্ভুনাথ ভার্যা বসে পাগলের ঠাই।
    মা! মা! বলিয়া তারে ডেকেছে গোঁসাই।।
    পাগল বলেন যাব তোমার আলয়।
    মা যদি করেন আজ্ঞা তবে যাওয়া যায়।।
    শুনিয়া রাইচরণ হইল উন্মনা।
    গোসা করি ফিরে এল পাগলে ডাকে না।।
    বিমর্ষ হইয়া রাই নিজ গৃহে গেল।
    চেয়ে দেখে গৃহ মধ্যে বসেছে পাগল।।
    রাইচরণের ভার্যা কদমী নামিনী।
    অপরে দোসরা তার নাম কাদম্বিনী।।
    পাগলের নিকটেতে বসিয়া রয়েছে।
    পাদ ধৌত করে সেবা শুশ্রূষায় আছে।।
    তাহা দেখি রাই সুখী হইল সন্তোষ।
    ঘুচে গেল মনেতে যা হয়েছিল দোষ।।
    রাইচরণকে ডেকে কহিছে গোঁসাই।
    গোলোকেরে ডাকিয়া আনহ মম ঠাই।।
    তাহা শুনি ভাবে রাই এ আর কেমন।
    কীর্তনিয়া আসিবেক কিসের কারণ।।
    যার দ্বারা মনের ঘুচিয়া যাবে কষ্ট।
    তাহার দ্বারায় মন আরো হয় নষ্ট।।
    মনে ভাবে ডাকিব সে যাহাতে না আসে।
    সে ভাবে সংবাদ দিল গোলোকের পাশে।।
    কীর্তনিয়া নাহি এল পাগল যথায়।
    এল না বলিয়া রাই সংবাদ জানায়।।
    গোস্বামী বলেন রাই বুঝিয়াছি মনে
    আসিতে দিলেনা তুমি সে আসিবে কেনে।।
    রাই তাই শুনিয়া বিস্মিত হৈল মনে।
    মনে যা ভেবেছি প্রভু জানিল কেমনে।।
    পাগল বলেন রাই মনে কি ভাবিস।
    এই সব উল্টা কল তুই কি বুঝিস।।
    লক্ষ্মীকান্ত টিকাদার ছিল সমিভ্যরে।
    ক্রোধেতে পাগল তারে দুই লাথি মারে।।
    মার খেয়ে লক্ষ্মীকান্ত ভভাবে হয় ভোর।
    বলে হারে দুষ্ট ভাল শাস্তি হৈল তোর।।
    রাইচরণকে কহে পাগল তখন।
    করহ কদলী তরু প্রাঙ্গণে রোপণ।।
    কলাগাছ এনে ত্বরা ফেলিল সেখানে।
    গর্ত করি রোপণ করিল সে উঠানে।।
    পাগল কহিছে তুই মানুষ বিদিক।
    এ কার্য করিতে রাই নাহি পাবি ঠিক।।
    লক্ষ্মীকান্ত টিকাদার ছিল যে সঙ্গেতে।
    তাকে বলে কলাগাছ রোপণ করিতে।।
    লক্ষ্মীকান্ত করিতেছে মৃত্তিকা খনন।
    রাই কহে পাগল ইহা করে কি কারণ।।
    লক্ষ্মীকান্ত বলে করি পাগল যা বলে।
    বোধ করি এখানে হইবে রাসলীলে।।
    এ হেন সময় শম্ভুনাথের ভবনে।
    অনেক লোকের আগমন সেইখানে।।
    কীর্তনিয়া মহাশয় সঙ্গেতে তাহারা।
    নাম সংকীর্তন করে হয়ে মাতোয়ারা।।
    হুঙ্কার করিয়া হরি বলেছে পাগল।
    জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।।
    শম্ভুর বাটীতে যত লোক সমারোহ।
    জ্ঞানশূন্য অচৈতন্য সবে গেল মোহ।।
    আরোপিল রম্ভাতরু উঠানের পাশে।
    চতুর্দিক বেড়ি ঘুরে মনের হরিষে।।
    লক্ষ্মীকান্ত বলে রাই করহ বিশ্বাস।
    বিশ্বাস করহ যদি এই মহারাস।।
    শম্ভুর বাটীতে সবে যাইয়া দেখহ।
    কীর্তন করিতে সবে হইয়াছে মোহ।।
    তথা দিয়ে দেখে সবে মোহ হইয়াছে।
    রাই কাঁদি কহিলেন পাগলের কাছে।।
    পাগল যাইয়া শম্ভুনাথের ভবনে।
    হরি বলি সবাকার করাল চেতন।।
    গঙ্গাচর্ণা মহারাস পাগলের কাজ।
    রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

    পাগলের তাল বৃক্ষ ছেদন
    পয়ার
    কতদিন পর্যন্ত সে রাই ভাবে মনে।
    পাগলের কার্য কিছু বুঝিতে পারিনে।।
    অমানুষী কার্য সব না বুঝে দেবতা।
    আমি কোন ছার এর মর্ম পাব কোথা।।
    পাগল চাঁদের দেখি মহিমা অপার।
    শ্রীমন্ত লোকের ভক্তি হইল সবার।।
    রাইচরণের ভক্তি একান্ত অন্তরে।
    মন হল পাগলকে আনিবার তরে।।
    রাইচরণের নাই আশার অবধি।
    নারিকেল বাড়ী গিয়া গেল ওঢ়াকাঁদি।।
    পাগল বসিয়া আছে ঠাকুরের বামে।
    রাই গিয়া ঠাকুরের শ্রীপদে প্রণামে।।
    ঠাকুরে জিজ্ঞাসা করে আলি কোথা হতে।
    মনের মানসা তোর পাগলকে নিতে।।
    রাই বলে আজ্ঞা প্রভো! অই মনোনীত।
    বুঝিয়া করুণ কার্য যে হয় উচিৎ।।
    ঠাকুর ইঙ্গিত কৈল গোলোকের পানে।
    গোলোক ইঙ্গিত বুঝি উঠিল তখনে।।
    অমনি চলিল রাইচরণ সঙ্গেতে।
    ঠাকুর নিকটে রাই নারিল বসিতে।।
    নারিকেল বাড়ী গিয়ে পাগলামী করে।
    মারপিট করে জোরে যারে তারে ধরে।।
    পদাঘাত মুষ্ট্যাঘাত চপেট আঘাত।
    দশ বার জনে করে ভূমিতে নিপাত।।
    পরে গেল করপাড়া যুধিষ্ঠির বাড়ী
    এক লাউ কাটিয়া পুরিল এক হাঁড়ি।
    জ্বাল দিয়া হাঁড়ির উপরে রেখে হাঁড়ি।
    উঠানে আনিয়া ভাঙ্গে লাউ পোড়া হাঁড়ি।।
    গোস্বামী তখন রাগে দর্প করে অতি।
    রাইচরণের পৃষ্ঠে মারে দুই লাথি।।
    দর্প করি বলে রাই শীঘ্র যারে বাটী।
    বাড়ী আছে তালগাছ শীঘ্র ফেলা কাটি।।
    তাহা শুনি রাই তবে বাটীতে আসিল।
    রাত্রি এল তালগাছ কাতিতে নারিল।।
    পাগল যথা তথায় পাগলামী করে।
    পাটগাতী খেয়াঘাটে রাত্রি দ্বিপ্রহরে।।
    পাটনীর ঘর খেয়া ঘাটের উপর।
    বলে ওরে পাটনী আমাকে পার কর।।
    পাটনী কহিছে রাগে তুই কার বেটা।
    এত রাত্রে বল তোরে পার করে কেটা।।
    জয় হরি বল রে গৌর হরি বল
    দর্প করি যখনেতে উঠিল পাগল।।
    পাটনীর হৃদকম্প হৈল তাহা শুনে।
    নিত্য পার করি মন্দ বলেছি না চিনে।
    রাবণ পাটনী নাম হয় যে আমার।
    পার করি অন্তে যদি মোরে কর পার।।
    প্রভু বলে যাহা দিবি পাবি সেই ধন।
    হরি তরাইবে তোরে বলিনু বচন।।
    এতবলি পাগল চলিল গঙ্গাচর্ণা
    রাইচরণের বাড়ী চলে উগ্র মনা।।
    বলে রাই মোর বড় ভ্রম হইয়াছে।
    আমাকে সুস্থির কর এসে মোর কাছে।।
    রাই ডেকে বলে তার রমণীর স্থান।
    পাগলকে সুস্থ করি তৈল জল আন।।
    তাহা শুনি ক্রোধেতে পাগলচাঁদ কয়।
    তেলে জলে সুস্থ হওয়া পাগল এ নয়।।
    তালগাছ কাটিতে তোমাকে আমি কই
    তাহা যদি কেটে ফেল তবে সুস্থ হই।।
    রাই কহে আসিতে যে রাত্রি হল মোর।
    অবশ্য কাটিব গাছ নিশি হলে ভোর।।
    প্রভাত সময় তালগাছ কেটেছিল।
    গাছের ডাগুয়া পাতা বাটীতে রাখিল।।
    বাস্তু ঘর বেড়া সঙ্গে বেড়া হেলা দিয়া।
    ডাগুয়া নীচায় পাতা উপরে রাখিয়া।।
    পাগল তাহার পরদিন ফিরি ঘুরি।
    গঙ্গাচর্ণা এল রাইচরণের বাড়ী।।
    রাত্রিযোগে পাগল সে ডাগুয়া পাতায়।
    আগুন লাগায়ে দিয়া নাচিয়া বেড়ায়।।
    হু হু শব্দ করি অগ্নি জ্বলে অবিরাম।
    রাই করে সোর শব্দ পুড়িয়া মলেম।।
    গৃহ মধ্যে গিয়া বলে পাগল গোঁসাই।
    শুয়ে থাক রাই তোর  কোন চিন্তা নাই।।
    বাহির হইয়া রাই দেখে অকস্মাৎ।
    আগুন হয়েছে উর্দ্ধ আট দশ হাত।।
    যে খানের আগুন নির্বাণ সেখানেতে।
    ঘর বেড়া কিছু না পুড়িল আগুনেতে।।
    পাগল কহিল রাইচরণের তরে।
    যাও যদি ওঢ়াকাঁদি এস সমিভ্যরে।।
    তাহা শুনি ভাসে রাই প্রেমের তরঙ্গে।
    প্রভাতে চলিল রাই পাগলের সঙ্গে।।
    পাগল আসিয়া বাসুড়িয়া গ্রামে রয়।
    রাইচরণকে কহে যাও নিজালয়।।
    কাছারী হইতে এক পেয়াদা আসিয়া।
    রাইচরণকে নিল কাছারী ধরিয়া।।
    নায়েব কহেন কেন গাছ কেটেছিস।
    গ্রামীরা জুঠিয়া সবে করিছে নালিশ।।
    আগুন জ্বালালি কেন ঘরের বেড়ায়।
    তুই পুড়ে যাস মোর গ্রাম পুড়ে যায়।।
    রাই কহে আমি এর কিছুই না জানি।
    ভাবের পাগল এক তার কথা শুনি।।
    সেই কহে তালগাছ কাটিবার তরে।
    গাছ কাটিয়াছি তার বাক্য অনুসারে।।
    গাছের বাগুয়া পাতা ঘরের পিছনে
    রাখিয়া ছিলাম পোতা বেড়ার সংলগ্নে।।
    রাত্রিযোগে ছিনু আমি ঘরেতে শুইয়া।
    পাগল আসিয়া দেয় আগুন জ্বালিয়া।।
    ডাগুয়া পুড়িয়া তার পাতা পুড়ে গেল।
    আট দশ হাত অগ্নি উর্দ্ধেতে উঠিল।।
    চালের উপর দিয়া অগ্নি বায়ুলায়।
    আগুন দেখিয়া আমি করি হায় হায়।।
    ভয় নাই কহে মোর পাগল গোঁসাই।
    তাল পাতা পুড়ে গেল ঘর পুড়ে নাই।।
    বাবু কহে পাগলের কার্যে দোষ নাই।
    ঈশ্বরের তুল্য ব্যাক্তি পাগল গোঁসাই।।
    তোমার নাহিক দোষ যাও নিজ ঘরে।
    পাগলে কহিও যেন দয়া থাকে মোরে।।
    কর্মকর্তা হরি পাগলের ঠাকুরালী।
    এত দিনে শত্রু মুখে পল চুনকালি।।
    পাগলে ভাবিয়া রাই উঠে কাঁদি কাঁদি।
    চারিদিন পরে যাত্রা কৈল ওঢ়াকাঁদি।।
    দেখিয়া ঠাকুর রাইচরণে জিজ্ঞাসে।
    অদ্য বাছা ওঢ়াকাঁদি এসে কই মানসে।।
    রাই কহে শ্রীচরণ দর্শন আশায়।
    মহাপ্রভু বলে বৎস! তাহা বুঝি নয়।।
    মোর প্রতি ভক্তি তোর আছে তনিশ্চয়।
    এবে আলি গোলোকেরে দেখিতে আশায়।।
    যেই ভক্ত সেই আমি গ্রন্থে লেখে স্পষ্ট।
    গোলোকে সেবিলে আমি আরো বেশী তুষ্ট।।
    বাড়ী ছিল তালগাছ কেটেছিস নাকি।
    আগুনে পুড়িস নাই শুনে হইনু সুখী।।
    যাহা হোক তাহা হোক আমার সৌভাগ্য।
    য়েছে তোমার বাড়ী রাজসূয় যজ্ঞ।।
    যা করে গোলোক আমি করি সেই কাজ।
    পয়ার প্রবন্ধে কহে কবি রসরাজ।।

    গোস্বামীর দক্ষিণ দেশ ভ্রমণ
    পয়ার
    কিছুদিন ওঢ়াকাঁদি করিয়া বিশ্রাম।
    পাগল চলিল পুনঃ গঙ্গাচর্ণা গ্রাম।।
    যাওয়া মাত্র রাইচরণকে ডেকে কয়।
    বইবুনে যাইব আমার সঙ্গে আয়।।
    অমনি চলিল রাই পাগল সঙ্গেতে।
    চলিলেন পাগলামী করিতে করিতে।।
    জয় হরি বল রে গৌর হরি বল
    রাম জয় ধ্বনি করি চলিল পাগল।।
    ধ্বনি শুনি লোক সব হইল চমকিত।
    মাঠিভাঙ্গা হাটখোলা হৈল উপনীত।।
    গোপাল বিশ্বাস উমাচরণ বিশ্বাস।।
    পাগলকে দেখে মনে বাড়িল উল্লাস।।
    উথলিল প্রেম বন্যা করিছে রোদন।
    পাগলকে করিলেন অর্চনা বন্দন।।
    জয় হরি গৌর হরি বলে বার বার।
    সিংহের গর্জনসম দিতেছে হুঙ্কার।।
    গোপাল বিশ্বাস উমাচরণ কহিছে।
    এই বাজারেতে এক দারগা এসেছে।।
    কোন এক মকর্দমা আসামী ধরিতে।
    নরহত্যা আসামীর আস্কারা করিতে।।
    কোন কোন লোকের করেছে অপমান।
    চুপে চুপে এইখানে করুণ প্রস্থান।।
    শুনিয়া পাগল আরো চেতিল দ্বিগুণ।
    আমি ভয় করিব করেছি কারে খুন।।
    জয় রাম গৌর হরি বলিয়া বলিয়া।
    হুঙ্কার ছাড়িয়া ভ্রমে বাজার বেড়িয়া।।
    লোকে বলে পাগল আসিল কোথা হতে
    দারোগা বলে পাগল হইল কি মতে।।
    তাহা শুনি পাগল করিল হুঙ্কার।
    লম্ফ দিয়া পড়ে দারোগার নৌকা পর।।
    আর লম্ফ দিয়া পড়ে দারোগার ঠাই
    দারোগা বলেন পদে রেখহে গোঁসাই।।
    বাজার বাহির হয়ে ধাইল পাগল।
    ক্ষণে রাম রাম ক্ষণে গৌর হরি বোল।
    একটি বেদের মেয়ে আসিয়া সেখানে।
    হরি বলে কাঁদে বারি ঝরে দুনয়নে।।
    পাগলের পদে পড়ে করিছে রোদন।
    বলে বাবা দয়া করি দেহ শ্রীচরণ।।
    আপনার জন্য কিছু দধি রাখিয়াছি।
    দয়া করি খাও যদি তবে আমি বাঁচি।।
    আমিত বেদের মেয়ে যবনের ঘরে।
    কোন সাহসেতে দধি দিবহে তোমারে।।
    পাগল কহিছে তুমি কি ব্যবসা কর।
    সে মেয়ে কহিছে সব জানিবারে পার।।
    মনোহারী মাল লয়ে পাড়াগাঁয় ভ্রমি।
    এক দরে কিনি এক দরে বেচি আমি।।
    কেহ যদি দায় ঠেকে করি উপকার।
    সাধ্য অনুযায়ী যাহা যার দরকার।।
    উপকার অর্থে অর্থ কারে যদি দেই।
    দিতে যদি পারে তার সুদ নাহি নেই।।
    তবে যদি সেই নিজে খুশী হয়ে দেয়।
    চাহিয়া কাহার কাছে করিনা আদায়।।
    শুনিয়া পাগল তার বদন চুম্বিল।
    পরে দধি এনে দিল পাগল খাইল।।
    সে স্থান হইতে যাত্রা করিল যখন।
    পাগলের সঙ্গে চলিল উমাচরণ।।
    উমাচরণের বাড়ী হইল উপনীত।
    ঘাটে গিয়া দাঁড়াইয়া রহে এক ভিত।।
    পুনঃ এসে বাড়ী পরে যত হাঁড়ি ছিল।
    বাহিরের ভাঙ্গা হাঁড়ি পাগল আনিল।।
    রাইচরণকে কহে কুড়াইয়া দেও।
    অকর্মা কলসী হাঁড়ি আমায় যোগাও।।
    চারি পাঁচ বাড়ী যত কলসী বা হাঁড়ি।
    মজুত করিল উমাচরণের বাড়ী।।
    পাগল চলিল ঘাটে হাঁড়ি কুম্ভ লয়ে
    রাই যোগাইয়া দেয় পিছু পিছু গিয়ে।।
    তাহা দেখি হাঁড়ি উমাচরণ দিতেছে
    দুজনে যোগায় গিয়া পাগলের কাছে।।
    ভাঙ্গা হাঁড়ি যত নিছে পাগল নিকটে
    আছাড়িয়া ভাঙ্গিতে লাগিল সেই ঘাটে।।
    বাহিরের সব হাঁড়ি ভাঙ্গা হয়ে গেল।
    আন আন আন শব্দ করিতে লাগিল।।
    তাহা শুনি উমাচরণের বৃদ্ধ মাতা।
    বলে উমা বল আর হাঁড়ি পাবি কোথা।।
    বাহিরের সব হাঁড়ি ফুরাইয়া গেল।
    ঘরে যাহা ছিল সব আনিতে লাগিল।।
    ঘরে ছিল নূতন নূতন যত হাঁড়ি।
    পাগলের নিকটেতে লয়ে যায় বুড়ি।।
    তাহা দেখি প্রভু বলে হল ঘাট বাঁধা।
    এঘাটেতে আর নাহি হবে সর কাঁদা।।
    জোয়ার ভাটার দেশ ঘাটে হয় কাঁদা।
    সেই জন্য হল মাগো এই ঘাট বাঁধা।।
    অদ্যাবধি সেই ঘাটে কাঁদা নাহি হয়।
    পাগলের বরে ঘাট শানতুল্য রয়।।
    পাগলের ঘাট বাঁধা অলৌকিক কাজ।
    রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

    পাগলের প্রত্যাবর্তন
    পয়ার
    উত্তরাভিমুখ চলে পাগল গোঁসাই।
    চলিলেন গঙ্গাচর্ণা সঙ্গে চলে রাই।।
    পার হতে মধুমতী নৌকা নাহি পায়।
    হাটুরিয়া এক নৌকা দেখিবারে পায়।।
    পাঁচ জন এক নায়ে হাটে যাইবারে।
    দোকান পসার তুলে নৌকার উপরে।।
    নৌকার নিকটে গিয়া বলিল গোঁসাই।
    এই নৌকা পরে তুমি উঠ গিয়া রাই।।
    রাই গিয়া উঠিল সে নৌকার উপরে।
    হাটুরিয়া একজনে বলে ক্রোধভরে।।
    আমরা চলেছি হাটে হারে বেটা বোকা।
    নৌকার উপরে কেন উঠিলি খামকা।।
    আর একজন এক বোঝা লয়ে এল।
    একাকী সে বোঝা সে নামাতে নারিল।।
    পাগল বলেছে রাই তুই তবর্বর।
    দাদার মাথার বোঝা শীঘ্র করি ধর।।
    রাই এসে সেই বোঝা শীঘ্র নামাইল।
    সাহা বলে তোমরা কোথায় যাবে বল।।
    রাই বলে যাব মোরা মধুমতী পারে।
    সাহা বলে উঠ দোঁহে দিব পার করে।
    সেই নৌকা পরে গিয়া উঠিল পাগল।
    মুখে বলে জয় হরি গৌর হরি বল।।
    পাগল বলেছে রাই হওগে কান্ডারী।
    তুমি গিয়া হাল ধর আমি দাঁড় ধরি।।
    সাহাজীরা বলে কেন তোমরা বাহিবে।
    আমরা করিব পার বসে থাক এবে।।
    পাগল তাহা না শুনি হাল গিয়া ধরে।
    রাই গিয়া দাঁড় ধরে আগা নৌকা পরে।।
    পাগল ধরিয়া হাল ঘুরাইছে নাও।
    বলে রাই হরি বলে জোর দিয়া বাও।।
    সাহাজীরা কয়জন জোরে টানে বৈঠে।
    পাগল বলেছে রাই দাঁড় ধর এটে।।
    অতি বেগে নৌকা চলে কান্ডারী পাগল।
    কিনারের লোক দেখে বলে হরিবোল।।
    জয় হরি বল মন গৌর হরি বোল।
    রাম রাম মহাধ্বনি করিছে পাগল।।
    এইমত পার হয় দশ বারো বার।
    নদী মধ্যে নৌকা ঘুরাইছে চক্রাকার।।
    সাহাজীরা বাক্য হত হয়েছে বিহ্বলা।
    পাগল বলেছে হাটে যেতে নাই বেলা।।
    এত বলি নৌকা নিল পশ্চিম কিনারে।
    লম্ফ দিয়া পাগল পড়িল গিয়া তীরে।।
    নৌকা বাহে সাহাজীরা হয়ে জ্ঞানহারা।
    পাগল বলেন কোথা বেয়ে যাস তোরা।।
    চৈতন্য পাইয়া সাহাজীরা করে মানা।
    আমাদের ছেড়ে প্রভু যেওনা যেওনা।।
    কূলে উঠে সাহাজীরা শ্রীচরণে পড়ে।
    বলে প্রভু আর বার উঠ নৌকা পরে।।
    হাটে না যাইব মোরা নৌকায় এসহ।
    আজ নিশি আমাদের বাসায় বঞ্চহ।
    প্রভু কহে হাট কর পুনঃ যদি আসি।
    তোমাদের বাসায় বঞ্চিব এক নিশি।।
    সাহারা অনেক কষ্টে বাক্যে দিল সায়।
    বলে প্রভু দয়া করে রেখ অই পায়।।
    হাট শেষ বেলা শেষ এমন সময়।
    দোকান পাতিল হাটে করিতে বিক্রয়।।
    বহুতর খরিদ্দার জুটিল দোকানে।
    কোন মাল কোন মূল্য কিছু নাহি শুনে।।
    ওজন করিতে বসে ওজন করয়।
    ক্রেতাগণ মনমত মূল্য দিয়া যায়।।
    বিক্রয় করিতে মাল যত এনেছিল।
    সকল বিক্রয় হল কিছু না রহিল।
    অসম্ভব একই কাজ বিক্রি সব দ্রব্য।
    অদ্যকার হাটে হৈল চতুর্গুণ লভ্য।।
    তারা হল হরি ভক্ত সাধুর সমাজ।
    রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।

    সংসার রঙ্গভূমি
    পয়ার
    আর একদিন গিয়া কার্তিকের ঘরে।
    কার্ত্তিক কার্ত্তিক বলে ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।।
    অম্বিকারে বলে মাগো মোরে খেতে দেও।
    কার্ত্তিক কোথায় গেছে ডাকিয়া আনাও।।
    অম্বিকা বলেছে আমি কিবা খেতে দিব।
    খুদ সিদ্ধ করিয়াছি কিবা খাওয়াইব।।
    পাগল বলেছে মাগো খুদ কৃষ্ণ খাদ্য।
    এনে দে মা শীঘ্র আমি খাব খুদ সিদ্ধ।।
    খুদ সিদ্ধ এনে দিল পাগলের ঠাই
    খেয়ে বলে মাগো আমি বড় মিষ্ট খাই।।
    পাগলের সিংহধ্বনি কার্ত্তিক শুনিল
    কিঞ্চিৎ বিলম্বে পাগলের কাছে এল।
    বলেছে কার্ত্তিক তুই থাকিস কোথায়।
    কার্ত্তিক বলেন আমি ছিলাম সভায়।।
    অদ্য আমি গিয়াছিনু গ্রাম্য নিমন্ত্রণে।
    স্বজাতির মধ্যে আমি ছিলাম ভোজনে।।
    পাগল বলে স্বজাতি তুই কস কারে।
    চক্ষে হস্ত বুলাইয়া বলে পুনঃ যারে।।
    শীঘ্র করি দেখে আয় রে বর্বর বেটা।
    দেখে আয় সভাতে মানুষ আছে কেটা।।
    কার্ত্তিক যাইয়া দাঁড়াইয়া সভা পার্শ্বে।
    দেখেছে সভায় যত চেগা বগা বসে।।
    শিয়াল কুকুর আর শকুন বিড়াল।
    ছাগ মেষ গো-মহিষ আছে পালে পাল।।
    পাঁচ ছয় শত লোক ছিল যে সভায়।
    তার মধ্যে শতেক মনুষ্য দেখা যায়।
    দেখিয়া কার্ত্তিক হল বিস্মিত হৃদয়।
    লুঠিয়া পড়িল এসে পাগলের পায়।।
    এ ভব মায়া প্রপঞ্চ সার কিছু নাই।
    কহিছে তারকচন্দ্র হরি বল ভাই।।

    রুদ্র-উদ্ধার
    পয়ার
    চলিল গোলোকচন্দ্র উত্তরাভিমুখে।
    বাসুড়িয়া গ্রামে যাব কহিল সবাকে।।
    ভক্তগণ কতক চলিল সঙ্গে সঙ্গে।
    হরি বলে হাসে কাঁদে নাচে গায় রঙ্গে।।
    রাইচরণ মদনকৃষ্ণ কোটিশ্বর।
    মহেশ শ্যামাচরণ শ্রীহরি পোদ্দার।।
    সবে যায় হরিবোল বলিতে বলিতে।
    উত্তরিল মধুমতী নদীর কূলেতে।।
    বড়গুণীর পশ্চিমে ভৈরব নগর।
    রুদ্র মণ্ডলের বাড়ী নদীর কিনার।।
    বাড়ী হতে মধুমতী অতি দূরে নয়।
    শত হস্ত পরিমিত যদি বেশী হয়।।
    পরিষ্কার ঘাট তার বাড়ীর নিকট।
    সবলোক তারে ব্যাখ্যা করে রুদ্রঘাট।।
    মতুয়ারা হরি বলে যবে যায় হেঁটে।
    মারিবার জন্য রুদ্র লাঠি লয়ে ছুটে।।
    তাহা দেখি মতুয়ারা চুপ করে যায়।
    কোনদিন তথা নাহি হরি নাম লয়।।
    এইভাবে বহুদিন চুপে চুপে যায়।
    অদ্য সেই ঘাটে গিয়া হইল উদয়।।
    পাগল বলিছে সবে সেই ঘাটে গিয়া।
    আজ সবে হরিবোল নাচিয়া নাচিয়া।।
    যাহার শরীরে আছে যতটুকু শক্তি।
    সেই শক্তি দিয়া নাম বল করে ভক্তি।।
    তাহা শুনি যার যত ছিল নিজ বল।
    সিংহের প্রতাপে সবে বলে হরি বল।।
    তাহা শুনি রুদ্র এক ষষ্ঠি নিল হাতে।
    যত হরিবোলাগণে আসিল মারিতে।।
    মহাদস্যু মহাকায় মহা বলবান।
    দেশের যতেক লোক ভয়ে কম্পমান।।
    পাগল দেখিয়া রুদ্র আসিল মারিতে।
    দৌড়িয়ে গেলেন সেই রুদ্রের সাক্ষাতে।।
    ক্রোধভরে কহে তারে ওরে রুদ্র দাদা।
    তোর ঘাটে হরিবলে এত বড় স্পর্ধা।।
    হরি হরি হরি বলে ওরা মারে ডঙ্কা।
    তুমি আমি দুই ভাই কারে করি শঙ্কা।।
    হরি বলে ভণ্ডামী করিছে সব ভণ্ড।
    আমি দিব উহাদের সমুচিত দণ্ড।।
    রুদ্রের হাতের ষষ্ঠি লইল কাড়িয়ে।
    আয় দাদা বলিয়ে চলিল বেগে ধেয়ে।।
    তর্জন গর্জন করি গোস্বামী চলেছে।
    পাগল চলিল আগে রুদ্র যায় পিছে।।
    গোস্বামী বলিছে পাষণ্ডীর রক্ষা নাই।
    কার ঘাটে হরি হরি বলিস সবাই।
    তর্জনে গর্জনে ধায় হরিবোলা দিকে।
    মারিবারে বাড়ি হাকে রুদ্রের সম্মুখে।।
    আগুলিয়া লম্ফ দিয়ে পিছে চলি যায়।
    অধরোষ্ট কাঁপে রাগে কাঁপিতেছে কায়।।
    বিমুখ হইয়া পড়ে হয়ে মাতোয়ারা।
    রুদ্রকে ঘিরিয়া করে লাঠি পাইতারা।।
    সঙ্গীরা ইঙ্গিতে হরি বলিতে বলিতে।
    ধরিয়া রুদ্রের হস্ত লাগিল ঘুরিতে।
    মধ্যে রুদ্র চতুর্দিকে নাচে ভক্তগণ।
    নদী মধ্যে গোলা পড়ি হইল তেমন।।
    তার মধ্যে হুহুঙ্কার ছাড়িল পাগল।
    জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।।
    অচৈতন্য হয়ে রুদ্র হইল বিহ্বলা।
    রুদ্রকে ঘেরিয়া হরি বলে হরিবোলা।।
    সবে বলে হরি বল বল হরি বল।
    রুদ্র সে চৈতন্য পেয়ে বলে হরি বল।।
    হরিবলে রুদ্র গোস্বামীর পায় পড়ি
    কীর্তনের মধ্যে রুদ্র যায় গড়াগড়ি।।
    রুদ্র বলে আমাকে বলিলে যদি দাদা।
    এইভাবে তব মন থাকে যেন সদা।।
    আমি তোর দাদা তুই মোর ভাই।
    জনমে জনমে যেন হেন সঙ্গ পাই।।
    ওঢ়াকাঁদি বাসী যত হরিভক্তগণ।
    জানিলাম তারা সবে পতিত পাবন।
    যুগে যুগে যত পাপী করেছ উদ্ধার।
    এমন পাষণ্ডী কোথা পেয়েছ কি আর।।
    মহাপ্রভুগণ মহাপ্রভুর সমান।
    আমি রহিলাম তার বিশেষ প্রমাণ।।
    আমি যদি তব দাদা তুমি যদি ভাই।
    তবে চল আমার বাড়ীর মধ্যে যাই।।
    পাগলের হস্ত ধরি রুদ্র চলে যায়।
    আগে রুদ্র পশ্চাতে পাগল দয়াময়।।
    তাহা দেখি হরিবোলা মতুয়া সকলে।
    রুদ্র মণ্ডলের প্রতি হরি হরি বলে।।
    বাড়ীর উপরে নিয়া বলে যোড় করে।
    সেবা কিছু কর ভাই বসে এই ঘরে।।
    গোস্বামী যাইয়া দেখে রন্ধন শালায়।
    পরিপূর্ণ এক হাঁড়ি অন্ন তথা রয়।।
    গোস্বামী বলেন দাদা লয়ে চল ঘাটে।
    মতুয়ার গণে আমি ইহা দিব বেটে।।
    চলিলেন যথা আছে সঙ্গী ভক্তগণ।
    হাঁড়ির মুখেতে দিল সরা আবরণ।।
    সেই অন্ন হাঁড়ি ধরি জলে ডুবাইল।
    জলমধ্যে বুড়বুড় করিতে লাগিল।।
    যত মতুয়ারগণ বাড়ীতে লইয়া।
    রুদ্র নাচে হরি বলি প্রেমেতে মাতিয়া।।
    বাড়ীর মধ্যেতে রুদ্র লইয়া তখনে।
    ভোজন করায় যত হরিভক্তগণে।।
    তাহা দেখি আসিলেন রুদ্রের রমণী।
    সব পাতে এনে দিল দধি আর চিনি।।
    গলে বস্ত্র দিয়া তবে কহে দুইজন।
    দয়া করি গৃহ মধ্যে চলহ এখন।।
    য়ে গেল পাগলেরে উত্তরের ঘরে।
    নারীসহ হরিবোল বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
    রুদ্র কেঁদে কহে শুন ভাইরে পাগল।
    ঘর বাড়ী পুত্র নারী তোমার সকল।।
    মতুয়ারা হরিবলে নাচিয়া নাচিয়া
    নারীসহ নাচে রুদ্র প্রেমেতে মাতিয়া।।
    মতুয়ারা সবে যায় এ ঘরে ও ঘরে।
    হরি হরি হরি বলে ঘর বাড়ী ঘিরে।।
    গোস্বামী বলেন দাদা যাই বাশুড়িয়ে।
    বিশ্বাসের বাড়ী যাব নদী পার হয়ে।।
    রুদ্র বলে অদ্য আমি পার করে দিব।
    আজ পার না করিলে কিসে পার হব।।
    রুদ্র বলে দেও ভাই এ সত্য কড়ার।
    আসিতে যাইতে দেখা দিবে একবার।।
    দশ বিশ জন এস কিংবা এস একা।
    আসিতে যাইতে মোরে দিয়া যাবে দেখা।।
    বৈঠা লয়ে রুদ্র এসে নিজ হাতে বেয়ে।
    পার করে দিল সবে নৌকায় উঠায়ে।।
    রুদ্রের উদ্ধার পার করিল গোঁসাই।
    রচিল তারকচন্দ্র হরি বল ভাই।।

    পাগলের ওলাউঠা তাড়ান
    পয়ার
    একবার নারিকেলবাড়ী সে গ্রামেতে।
    উপনীত ওলাউঠা ব্যাধি সে স্থানেতে।।
    মরিল অনেক লোক ভাব বিপরীত।
    তাহাতে অনেক লোক হৈল চমকিত।।
    ভয়ভীত হয়ে কেহ না পারে চলিতে।
    রাত্রি দ্বার বন্ধ, নাহি চলে দিবসেতে।।
    মহানন্দ নাগর চলিল ওঢ়াকাঁদি।
    কহে সব ঠাকুরের শ্রীচরণ বন্দি।।
    নাগর সরিষা নিল বসনেতে বাঁধি।
    ওলাউঠা আসিয়াছে কহে কাঁদি কাঁদি।।
    ঠাকুর কহেন তাতে তোদের কি ভয়।
    যা হবার হউক তোদের নাহি দায়।।
    তবু কহে নাগর উপায় কিবা করি।
    প্রভু কহে ভয় নাই বল হরি হরি।।
    গোস্বামী গোলোক তাহা শুনে দাঁড়াইয়া।
    গোপনে নাগরে নিল ইঙ্গিত করিয়া।।
    কহিছে তোমরা সবে কর দরবার।
    আমি যাইতাম দেশে বাসনা আমার।।
    মহাপ্রভু নিকটে নাগর কহিতেছে।
    গোলোকে পাঠান যদি তবে ভয় ঘুচে।।
    ঠাকুর বলেন কেন গোলোক যাইবে।
    হরি বল হবে ভাল ভয় নাহি রবে।।
    তবু আর বার গিয়া কহিছে নাগর
    জীবনের আশা নাই হয়েছি কাতর।।
    ঠাকুর বলেন এত ভয় কি লাগিয়া।
    আন দেখি দিব আমি সরিষা পড়িয়া।।
    সরিষা পড়া লাগিয়া মনের বিশ্বাস।
    য়ে যা সরিষা পড়া ভয় হবে নাশ।।
    আর বার নাগর করিছে দরবার।
    দাদা গেলে ভয় মোরা করিব না আর।।
    ঠাকুর বলিল তবে গোলোক নিকট।
    যাও বাছা কারু সঙ্গে না করিও হট।।
    শুনিয়া গোলোকচন্দ্র যায় দৌড়াদৌড়ি।
    সত্বরে উত্তরে গিয়া নারিকেল বাড়ী।।
    জয় হরি বল রে গৌর হরি বল
    হুহুঙ্কার করি গিয়া উঠিল পাগল।
    দম্ভ করি গোস্বামী দিলেন এক লম্ফ।
    তাহাতে গ্রামেতে যেন হল ভূমিকম্প।।
    দুর্গাচরণের বাড়ী নবীনের ঘরে।
    কবিরাজ এসেছিল পূজা পাতিবারে।।
    পাগল হুঙ্কার করি কবিরাজে কয়।
    এই পূজা দিলে যদি কলেরা না যায়।।
    যত লোক মরে তার সব দাবী দিবি।
    পূজা দিয়া কলেরা কি তাড়াতে পারিবি।।
    দুর্গাচরণেরে বলে ছাড় গণ্ডগোল।
    ওঢ়াকাঁদি মুখো হয়ে হরি হরি বোল।।
    তথা হতে চলিলেন বাহুলের ঘরে।
    তিন মেয়ে ব্যাধিযুক্ত কহে বাহুলেরে।।
    মেয়ে যদি মরে আমি সে জবাব দিব।
    হরিচাঁদ নামে আমি কলেরা ঘুচাব।।
    মেয়ে থাক ঘরে তোরা মোর সঙ্গে চল।
    একান্ত মনেতে তোরা হরি হরি বল।।
    ওঢ়াকাঁদি প্রভু নামে মান জরিমানা।
    কলেরায় মেয়ে তোর মরিতে দিব না।।
    বাহুল আইল সঙ্গে চিন্তা নাহি আর।
    হরি বলে পাগল ছাড়িয়ে হুহুঙ্কার।।
    গ্রামের লোকের শঙ্কা ঘুচিল সকল।
    দিবানিশি সমভাব নির্ভয় হইল।।
    কবিরাজ যেই রাত্রি পূজা পেতেছিল।
    ভয় পেয়ে সেই রাত্রি পালাইয়া গেল।।
    পাগল বসিল আসি নাগরের ঘরে।
    সেই ঘরে থেকে সবে হরি নাম করে।।
    বাটীর ঈশান কোণে এক শব্দ পেয়ে।
    সেই কোণে পাগল চলিল ক্রোধে ধেয়ে।।
    নাগরে বলিল ডেকে থাক গিয়া ঘরে।
    ওঢ়াকাঁদি মুখো হয়ে ডাকগে বাবারে।।
    নাগর আসিয়া ঘরে নিদ্রা নাহি যায়।
    হরিনাম লয়ে সেই রজনী পোহায়।।
    সে পাগল সিংহের প্রতাপে হরি বলে
    আগে আগে ওলাউঠা দৌড়ে যায় চলে।।
    হস্তীর বৃংহতি রব শুনায় যেমন।
    কলেরা দৌড়ায় শব্দ হতেছে তেমন।।
    চলিল সে ওলাউঠা পূর্বমুখ হয়ে।
    নির্ভয় গোলোক তারে নিল ধাওয়ায়ে।।
    গ্রাম মধ্যে রাত্রি ভরি ভ্রমিছে পাগল।
    গ্রাম্য লোক তাহা শুনি বলে হরিবোল।।
    কলেরা উঠিল গিয়া খোলের ভিটায়।
    তারপর পাগল চলিল নিজালয়।।
    পর রাত্রি খালিয়ার ভিটায় চলিল।
    প্রভু হরিচাঁদ বলি পাগল ডাকিল।।
    সে ভিটা ছাড়িয়া গেল ওড়ার ভিটায়।
    তাহা দেখি পাগল চলিল নিজালয়।।
    পাগল বলিল মহানন্দ নাগরকে।
    নিজড়ায় কলেরা গিয়াছে দায় ঠেকে।।
    সেখানে যদিচ থাকে সেও ভাল নয়।
    নিজড়া গ্রামেতে যাব আজকে নিশায়।।
    মহানন্দ নাগর করিছে তাতে মানা।
    সে গ্রামে থাকিলে কোন ক্ষতি হইবে না।।
    নিশীথে পাগল গেল নিজড়া গায়।
    হরিধব্বনি দিয়া উঠে ওড়ার ভিটায়।।
    কলেরা আসিয়া তথা হল মূর্তিমন্ত।
    প্রকাণ্ড শরীর তার বড়ই দুরন্ত।।
    ভূতভিটা বলি তার আছে পরিচয়।
    ভিটার উপর থাকি ডাক দিয়া কয়।।
    তোর ভয়ে আমি আসিয়াছি এই গ্রামে।
    তুই কেন হেথা আলি দ্বিতীয়ার যমে।।
    আলি যদি তবে বেটা আয় এই ঠাই।
    পড়িলি আমার হাতে তোর রক্ষা নাই।।
    আয় দেখি হস তুই কোন কাজে কাজী।
    আজকার সংগ্রাম হইবে বোঝাবুঝি।।
    পাগল বলেন তুই ভয়ে পলাইলি।
    আজ তুই এত বল কোথায় পাইলি।।
    আমি হরিচাঁদ বলি ছাড়ি হুহুঙ্কার।
    লম্ফ দিয়া পৈল গিয়া ভিটার উপর।।
    কলেরা বলেছে বেটা শীঘ্র যারে উঠে।
    চিরকাল অধিকার মোর এই ভিটে।।
    প্রভু বলে এ ভিটা ছাড়িব কি কারণ।
    মরি কিংবা মারি তোরে এই মোর পণ।।
    আমি যদি মরি তবে অধিকার তোর।
    তোরে যদি মারি তবে অধিকার মোর।।
    ভিটা ঘিরি ওলাউঠা ঘুরিয়া বেড়ায়।
    পূর্ব মুখ প্রভু বৈসে আনন্দ হৃদয়।।
    সম্মুখে আসিল যদি ঘুরে তিন পাক।
    পাগল কহিছে তোর ঘুচাইব জাঁক।।
    থাক থাক ওরে দুষ্ট আর যাবি কোথা।
    একটানে আমি তোর ছিঁড়ে নিব মাথা।।
    পাগলের সম্মুখেতে ঝাউবন ছিল।
    লম্ফ দিয়া পড়ি তিন গাছ উপাড়িল।।
    সেই গাছ ধরি বেগে ধাইয়া চলিল।
    ডঙ্কা দেখি শঙ্কা করি ওলাউঠা গেল।।
    পাগল বলেন পালাইয়া যাস কোথা।
    আমাকে কি বলে যাস বল সেই কথা।।
    ওলাউঠা বলে আমি তোমার সাক্ষাতে।
    যতদিন আমি আছি এই সংসারেতে।।
    ততদিন আসিব না এই অধিকারে।
    সত্যতা কড়ার আমি দিলাম তোমারে।।
    এ অধ্যায় শুনিলে ঘুচিবে ব্যাধি ভয়।
    ধন পুত্র যশ প্রাপ্ত আয়ু বৃদ্ধি হয়।।
    হরিচাঁদ পদযুগ্ম যোগে যোগে ভাবি।
    রচিল তারকচন্দ্র সরকার কবি।।


    No comments:

    Post a Comment

    শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত

    শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা

    শ্রীশ্রীহরিসঙ্গীত গান

    শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী শ্রী গোপাল চাঁদ সাধু ঠাকুুরে আদর্শ তথা মতুয়া দর্শনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলুন। হরিনাম করুন.