মধ্যখণ্ডঃ সপ্তম
তরঙ্গ (২য় অংশ)
মহাপ্রভুর সঙ্গে পাগলের করণ
যুদ্ধ
ত্রিপদী
গোস্বামী গোলোক
মাতাইল লোক
হরিচাঁদ নাম দিয়া।
মত্ত হরিনামে
সদা কাল ভ্রমে
ভকত ভবনে গিয়া।।
গিয়া সুর গ্রাম
করে হরিনাম
আড়ঙ্গ বৈরাগী ঘরে।
পাগলে দেখিয়া
মেয়েরা আসিয়া
আনন্দে রন্ধন করে।।
পাক হৈল সারা
আসিয়া মেয়েরা
গলে বস্ত্র দিয়া কয়।
হ’য়েছে রন্ধন
করুণ ভোজন
অন্ন জুড়াইয়া যায়।।
এমন সময়
শুনিবারে পায়
যুধিষ্ঠির রঙ্গ বাসে।
সিঙ্গা সাতপাড়
ঠাকুর তোমার
উদয় হ’লেন এসে।।
শুনিয়া পাগল
বলে হরিবোল
উৎকণ্ঠিত হ’য়ে উঠে।
আড়ঙ্গেরে কয়
যাইব তথায়
শীঘ্র লহ নৌকা বটে।।
নৌকা নাহি ঘাটে
পাগল নিকটে
আড়ঙ্গ বৈরাগী কয়।
কহিছে পাগল
ছাড় গণ্ডগোল
বিলম্ব নাহিক সয়।।
নাহি কিছু মানি
নৌকা দেহ আনি
ঠাকুর দেখিতে যাই।
না দেখে ঠাকুরে
মরিরে মরিরে
ত্বরায় তরণী চাই।।
যদি নাহি দেহ
তবে নিঃসন্দেহ
আমি দিব জলে ঝাঁপ।
তাতে যদি মরি
আমি পাব হরি
তোর হ’বে মহাপাপ।।
কি দিব তরণী
তরী একখানি
জলেতে ডুবান আছে।
ভাঙ্গা বড় নাও
তাতে যদি যাও
তবে দিতে পারি সেচে।।
দু’জনে হইলে
একেলা বাহিলে
একজন ফেলে জল।
তবে যাওয়া যায়
সেই ভাঙ্গা নায়
কর যদি এ কৌশল।।
মেয়েরা তখন
করিতে ভোজন
পাগলকে কেঁদে কয়।
পাগল কহিছে
ক্ষুধা কার আছে
তোর অন্ন কেবা খায়।।
মেয়েরা কাঁদিয়া
অন্ন দিল নিয়া
খেল মাত্র দুই গ্রাস।
রায়চাঁদে কয়
শীঘ্র আয় নায়
যদি দরশনে যা’স।।
পাগল কহিছে
নাও দেও সেচে
যদি মোরে ভালোবাস।
বাহিয়া যাইতে
একজন সাথে
দেহ নৈলে নিজে এস।।
নৌকা সেচে দিল
বৈঠা খানা নিল
পাগল উঠিল নায়।
ঠাকুর দেখিতে
নৌকা বেয়ে যেতে
রায়চাঁদ সাথে যায়।।
তরণী বাহিছে
বেগে চালায়েছে
বিক্রমশালী বিশাল।
যাও যাও বলে
যাও যাও
বলে
পাগল সেচিছে জল।।
জোরে খোঁচ দেও
জোরে বাও নাও
যদি দেহ জোর ছেড়ে।
জোর দিলে কম
আমি তোর যম
মুণ্ড ফেলাইব ছিঁড়ে।।
মরি কিংবা বাঁচি
আছি কিনা আছি
না জানিয়া মানি এত।
যা হও তা হও
নৌকা বেয়ে যাও
এ নাও চালাও দ্রুত।।
যত বাহে নাও
তত বলে বাও
বিলম্ব নাহিক সহে।
রায়চাঁদ বায়
যত শক্তি গায়
কালঘর্ম দেহে বহে।।
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস
ঘন ঘন শ্বাস
মরণ প্রশ্বাস প্রায়।
ডান হাতে জল
ফেলেছে পাগল
বাম হাতে নাও বায়।।
ডালির উপরে
বক্ষঃ রাখি জোরে
বামহাত জলে দিয়া।
জল টানি টানি
চলিল অমনি
যায় তরণী বাহিয়া।।
অর্ধ পথে গিয়া
পড়িল শুইয়া
বলে একা বেয়ে চল।
নৌকা চালাইবি
এ মতে বাহিবি
নৌকায় না উঠে জল।।
রায়চাঁদ জোরে
বাহে বেগভরে
নৌকায় না উঠে বারি।
উতরিল শিঙ্গা
পাগলের ডিঙ্গা
অকূলে তরিল তরী।।
ঠাকুরকে দেখি
নৌকা ঘাটে রাখি
দৌড় দিয়া চলে যায়।
প্রভু হরিচাঁদে
হেরি মনোসাধে
অমনি পদে লোটায়।।
রহে দণ্ড চারি
ঠাকুরে নেহারী
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করে।
আমারে দেখিলে
এলে কিনা এলে
যুধিষ্ঠির রঙ্গ ঘরে।।
কহিছে গোলোক
হইয়া পুলক
ত্রিলোক পালক হরি।
যথা তথা রহ
নাহিক সন্দেহ
উৎসাহে শ্রীপদ হেরি।।
আপনি সবার
জীবন আধার
যান সবাকার ঠাই।
আসি পুলকেতে
আপনা দেখিতে
এ বাড়ীতে আসি নাই।।
কহিল যখন
ঠাকুর তখন
ক্রোধ রক্তজবা চক্ষু।
এত বড় হলি
এ বাড়ী না এলি
কি কহিলি ওরে মূর্খ।।
ছিলেন বসিয়া
ঠাকুর রুষিয়া
দুরন্ত রাগের সাথ।
ঠাকুর তখনে
গোলোক বদনে
মারিল চপেটাঘাত।।
তখন গোলোক
অন্তরে পুলক
বাহিরে পাবক ন্যায়।
এক লম্ফ দিয়া
ঠাকুরে লঙ্ঘিয়া
ঘরের বাহিরে যায়।।
গোলোকে দৌড়িয়া
ঘাটেতে আসিয়া
অবিলম্বে নাও ছাড়ি।
রায়চাঁদে ফেলে
আসিয়া উঠিলে
কুবের বিশ্বাস বাড়ী।।
এ দিকে ঠাকুর
ক্রোধিত প্রচুর
রায়চাঁদ ডেকে কয়।
কোথায় ঠাকুর
পেলি এতদূর
হারে দুষ্ট দুরাশয়।।
শুনিবারে পাই
আমি যথা যাই
ও বলে আসে না তথা।
বুঝে দেখ মনে
আমারে কি মানে
কেন কহে হেন কথা।।
কবে রে ঠাকুর
হ’লি এতদূর
পোতায় ছিল না ঘর।
যার মেয়েলোকে
মাঠে বই রাখে
এত বৃদ্ধি কেন তার।।
প্রভু দেন গালি
যাহা যাহা বলি
পাগলের বংশে নাই।
রঙ্গবাড়ী ঠেকে
গালি দেন রুখে
সেই বংশে আছে তাই।।
চক্র নাহি সোজা
চক্রী চক্র বোঝা
কি চক্রে কারে ঘুরায়।
কুবের ভবনে
আসিয়া তখনে
পাগল নিরস্ত হয়।।
কুবেরের বাসে
রায়চাঁদ এসে
উপনীত যখনেতে।
কুবের নারীকে
বলেছেন ডেকে
রায়চাঁদে দেও খেতে।।
রায়চাঁদ কয়
খাওয়ালে আমায়
সঙ্গে করে এনেছিলে।
বহু পরিশ্রমে
আসি সিঙ্গা গ্রামে
খুব ভাল খাওয়ালে।।
শুনিয়া পাগল
বলে হরিবোল
জয় হরি বলে উঠে।
রুষিল দুরন্ত
যেমন জলন্ত
পাবকে উল্কা ছুটে।।
কুবেরের ঘরে
আনিতে ঠাকুরে
যুধিষ্ঠির বাড়ী যথা।
ঠাকুর আসিতে
ভক্তিযুক্ত চিতে
কুবের গিয়াছে তথা।।
পায়স পিষ্টক
ব্যঞ্জনাদি টক
লাবড়া ডাউল শাক।
ঠাকুরে আনিতে
ভক্তিযুক্ত চিতে
এদিকে হ’য়েছে পাক।।
কুবেরের নায়
উঠে দয়াময়
আসিতেছে তার বাসে।
পাগল শুনিয়া
ধাইয়া যাইয়া
ঘাটে দাঁড়াইল রোষে।।
ঠাকুরে চাহিয়া
কহিছে ডাকিয়া
আয় দেখি আয় আয়।
ঠাকুর কেমন
বুঝিব এখন
কে কেমন দয়াময়।।
ঠাকুর আমায়
কে বলে কোথায়
ঠাকুর বানালে কেটা।
তুই না ঠাকুর
বানালি ঠাকুর
আমি ঠাকুরের বেটা।।
মানিনে ঠাকুর
অই যে ঠাকুর
শতেক ঠাকুর এলে।
ঠাকুর দেখিব
আজ কি ছাড়িব
ঠাকুরে ডুবা’ব জলে।।
তুই যা’স যথা
আমি নাহি তথা
এ কথা ভাবিস কেনে।
যাই কিনা যাই
দেখাইব তাই
জানিতে পারিবি মনে।।
বক্ষঃ বিদরিয়া
দিব দেখাইয়া
তেমন নির্বোধ নয়।
পর দেহ ধরি
কার দেহ চিরি
অধিকার নাহি তায়।।
তার একজন
পবন নন্দন
হৃদি বিদারী দেখায়।
করিল জহুরী
তাতে লাজে মরি
পশু শিশু আমি নয়।।
থাকিয়া অন্তরে
কি জেনে অন্তরে
মারিস অন্তর হ’য়ে।
কে তোর আপন
বুঝিব এখন
আয় দেখি নাও বেয়ে।।
দিব জলাঞ্জলী
সব ঠাকুরালী
যা থাকে আমার ভাগ্যে।
বুঝিব ক্ষমতা
আজ সেই ক্রেতা
দেখুক ভকত বর্গে।।
এক এক বার
ভীষণ চীৎকার
কহিছে সার রে সার।
অধরোষ্ঠ কম্পে
এক এক লম্ফে
ভূমিকম্পে লম্ফে তার।।
ঠাকুর দেখিয়া
ভয়ে ভীত হৈয়া
কহিছে কুবের ঠাই।
চেয়ে দেখ আড়ি
আজ তোর বাড়ী
গিয়া মম কাজ নাই।।
অদ্য কিবা ঘটে
কি আছে ললাটে
যাইব না ফিরে চল।
প্রভু পুনরায়
রঙ্গ বাড়ী যায়
নাহি যেন বুদ্ধি বল।।
কুবের আসিল
পাগলে বলিল
ঠাকুর এলনা হেথা।
আমি অভাজন
করি কি এখন
উপায় কি যা’ব কোথা।।
কহিছে গোলোক
কেন হেন শোক
পিতা কি ছাড়িবে সুতে।
এল এল এল
না এল না এল
দয়া কি পারে ছাড়িতে।।
দ্রব্য আদি যত
করেছে প্রস্তুত
রাখিয়াছে ভারে ভারে।
মাথায় লইয়া
রঙ্গ বাড়ী নিয়া
খাওয়ে এস বাবারে।।
ভরি দুই হাঁড়ি
রঙ্গদের বাড়ী
কুবের
যখনে যায়।
গললগ্নী বাসে
ভকতি উল্লাসে
গোলোক পুলকে ধায়।।
রঙ্গের ঘাটেতে
যায় যখনেতে
ঠাকুর আসিল ঘাটে।
গোলোক পাগলে
কুবের কহিলে
হরিচাঁদের নিকটে।।
শুনিয়া শ্রীহরি
কহিল শ্রীহরি
যুধিষ্ঠির রঙ্গে কয়।
কুবের সঙ্গেতে
আমি এখনেতে
চলিলাম নিজালয়।।
সেইত তরণী
পাইয়া অমনি
শ্রীহরি উঠিল নায়।
কুবের সঙ্গেতে
ব্যতিব্যস্ত চিতে
আসিলেন নিজালয়।।
এল যুধিষ্ঠির
চক্ষে বহে নীর
গোলোক আসিল তথা।
ভকত লইয়া
ঠাকুর বসিয়া
কহিছেন মিষ্ট কথা।।
হস্তে ধরি ধরি
নিয়া অন্তঃপুরী
কুবের তখনে দিল।
কে দিয়াছে এত
দ্রব্য অপ্রমিত
মাতা লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিল।।
যত কহে বাণী
লক্ষ্মী ঠাকুরাণী
কুবেরকে লক্ষ্য করি।
কুবের কহিছে
জননীর কাছে
চক্ষে ঝরে অশ্রুবারী।।
দেবী লক্ষ্মীমাতা
শুনিয়া সে কথা
কহিছে রঙ্গের ঠাই।
তুমি কি করেছ
মনে কি ভেবেছ
গোলোক তোমার ভাই।।
ঠাকুর যখনে
গোলোক বদনে
করাঘাত করিলেন।
গোলোক কি দোষী
প্রভু কন রুষী
গোলোকেরে মারিলেন।।
করিয়া শ্রবণ
ঠাকুর তখন
যুধিষ্ঠির প্রতি কয়।
মোর এই ছল
এই কথা বল
কি হইবে ব্যবস্থায়।।
গোলোক তাহাতে
কুবের বাড়ীতে
রহে ঈশ্বর ভাবিয়া।
গোলোক সাহায্য
কি করেছে কার্য
আবার নিকট গিয়া।।
কুবের বাড়ীতে
গোলোক যাইতে
আমাকে করেছে মানা।
তোমার বাটীতে
আমাকে রাখিতে
গোলোকের সে বাসনা।।
অপূর্ব অপূর্ব
কুবেরের দ্রব্য
তোমার বাটীতে যায়।
আমি খা’ব তাই শুনিবারে পাই
গোলোক পাঠায়ে দেয়।।
গোলোক তোমার
করে উপকার
তার কি করেছ তুমি।
ঠাকুর নিয়াছ
মনে কি ভেবেছ
ঠাকুর হ’য়েছি আমি।।
মেরেছি গোলোকে
তব বাড়ী থেকে
তুমি কেন কাঁদিলে না।
গোলোক কারণে
আমার সদনে
মাথা কেন কুটিলে না।।
ঈশ্বরের কাজ
জগতের মাঝ
জীবের শুধু পরীক্ষা।
লোকেরে দেখায়ে
কন্যাকে মারিয়ে
বউমাকে দেন শিক্ষা।।
সামাল সামাল
আপনা সামাল
কপালে কি কার আছে।
পর দুঃখে দুঃখী
পরসুখে সুখী
এভাবে প্রেম রয়েছে।।
হ’য়েছে ঠাকুর
গৌরব প্রচুর
ভেবেছ কি বুঝি বুঝি।
কাজে পাওয়া যায়
সব পরিচয়
কে কেমন কাজে কাজী।।
বৈষ্ণবের পদে
ক্ষুদ্র অপরাধে
মহা মহা মহাজন।
বলে হরি হরি
সাধে কল্প ভরি
হরি না পাবে সে জন।।
যেই হরি ভজে
ভকত সমাজে
যে পূজে ভকত পায়।
বুঝিয়া ভজন
করে যেই জন
হরিপদ সেই পায়।।
সব পরিহরি
বল হরি হরি
থাকত ভকত মাঝ।
কহে মনোসাধে
হরিচাঁদ পদে
রায় কবি রসরাজ।।
শ্রীধাম ওঢ়াকাঁদি ঘাটলা
বন্ধন
পয়ার
একদিন পৌষমাসে রজনী প্রভাতে।
মহাপ্রভু বসেছেন পুকুর
পাড়েতে।।
উত্তর কূলেতে এক ঘাট বাঁধা
আছে।
খাম্বা হেলি তক্তাগুলি খসিয়া
পড়েছে।।
ঠাকুর ডাকেন ওরে গোলোক
কোথায়।
ঘাট ভেঙ্গে গেছে বাছা বেঁধে
দে ত্বরায়।।
আজ্ঞামাত্র গোলোক নামিল গিয়া
জলে।
হেলেছিল খাম্বাগুলি উঠাইল
ঠেলে।।
ভাল করি খাম্বা পুতি বাঁশ
পাতি দিল।
দৃঢ় করি আরো দুটি খাম্বা
লাগাইল।।
দুই ধারে দুই বাঁশ দিলেন
আড়নী।
তাহার উপরে বাঁশ পাতি দিল
আনি।।
দুই ধারে বাঁধে ঘাটে বিচিত্র
বাখানী।
ঠিক যেন দুই থরে ইটের নিছনী।।
গোলোক নামিল যবে জলের ভিতরে।
মহাপ্রভু তখনে গেলেন
অন্তঃপুরে।।
একেত দুরন্ত শীত সহন না যায়।
আরো উত্তরিয়া হাওয়া লাগিতেছে
গায়।।
পাগলের অসহ্য সে শীতের
যাতনা।
হেনকালে মনে মনে করছে
ভাবনা।।
থর থর কম্প শীতে কাঁপে
অধরোষ্ঠ।
গুরুকার্যে এত কষ্ট মম
দূরাদৃষ্ট।।
বুড়া হাড়ে সহিতে না পারি এত
কষ্ট।
ইহা হ’তে শতগুণে মৃত্যু মম শ্রেষ্ঠ।।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাঁধা হ’ল ঘাট।
হেনকালে গেল প্রভু পুকুরের
তট।।
প্রভু বলে ঘাট বাঁধা হয়েছে
সুন্দর।
শেলাগুলি তুলি ফেল কূলের
উপর।।
অন্তঃপুরে থেকে ডেকে কন
ঠাকুরানী।
পাকশালা হ’তে বলে জগৎ জননী।।
একেত গোলোক চাহিতেছে মরিবার।
গোলোকে কষ্টের কার্য নাহি
দিও আর।।
ঠাকুর গোলোকে কহে শুনে মরি
লাজে।
মরিতে চাহিস বেটা এইটুক
কাজে।।
তুচ্ছ ঘাট বাঁধা তাতে মরিতে
চাহিলি।
ত্রেতাযুগে সেতুবন্ধন কেমনে
করিলি।।
হারিলি কামের ঠাই বলে ও
হারিলি।
হারিলি শীতের ঠাই কুলে দিলি
কালি।।
শ্রীমুখের এইবাক্য শুনিয়া
গোলোক।
উত্তেজিত হয় যেন জলন্ত
পাবক।।
নামিয়া পড়িল জলে হইয়া
ক্রোধিত।
মহাবীর্যে রত কার্যে পালাইল
শীত।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
সিংহসম ধ্বনি করি উলটিছে
জল।।
ঝাঁপ দিয়া পড়ে জলে করি
হরিধ্বনি।
অর্ধ দণ্ডে ছাপ কৈল অর্ধ
পুষ্করিণী।।
শৈবালাদি যত ছিল উত্তরের
দিকে।
দুহাতে সাপুটে ধরি কূলে মারে
ফিকে।।
শতজনে দিনভরি যাহা নাহি
পারে।
অর্ধদণ্ডে একা তাহা করিল
সত্বরে।।
অর্ধ পুষ্করিণী ছাপ যখন হইল।
উঠরে গোলোক বলি ঠাকুর
ডাকিল।।
মহাপ্রভু বলে হ’ল পুকুর নির্মল।
গোলোকের
গুণে জল যেন গঙ্গাজল।।
এইরূপে পুষ্করিণী পরিষ্কার
করে।
গোলোক গোঁসাই গেল বাড়ীর
ভিতরে।।
গোলোকে ডাকিয়া বলে দেবী
শান্তিমাতা।
মরিতে চাহিলি এবে শীত গেল কোথা।।
গোলোক চরণে পড়ি বলেছে ভারতী।
জনমে জনমে যেন পদে থাকে
মতি।।
হরিচাঁদ লীলাকথা সুধাধিক
সুধা।
রচিল তারক পুষ্করিণী ঘাট
বাঁধা।।
শ্রীমদ্গোলোক গোস্বামীর
মানবলীলা সম্বরণ
পয়ার
পাগলের পেটে ছিল দুরন্ত
বেদনা।
সময় সময় হ’ত একান্ত যাতনা।।
ফুফুরা নিবাসী শ্রী ঈশ্বর
অধিকারী।
পাগলের যাওয়া আসা ছিল সেই
বাড়ী।।
চৈত্রমাসে সে বাড়ীতে
গোস্বামী আসিয়া।
অধিকারী মহাশয় সঙ্গেতে
মিলিয়া।।
সেই দিন অধিকারী বাটীতে
ছিলেন।
উভয় মিলিয়া নদীকূলে আসিলেন।।
মধুমতী নদীকূলে ঘাট একখান।
পাগল করিত এসে সেই ঘাটে
স্নান।।
অধিকারী মহাশয় মাতিলেন মতে।
বড় আর্তি হ’ল তার পাগলের সাথে।।
হরিচাঁদ প্রভু মোর
ঈশ্বরাবতাংশ।
ঈশ্বরাধিকারী প্রভু
পিতৃগুরুবংশ।।
প্রভু হরিচাঁদ হ’ন বাঞ্ছাকল্পতরু।
অধিকারী মহাশয়
প্রভু-পিতৃগুরু।।
মতুয়া হইয়া গেল বলি হরিবোল।
নিজ পরিবার সহ মাতিল সকল।।
পূর্বাপর বংশ তাঁর সকল মহৎ।
ওঢ়াকাঁদি মুখ হ’য়ে করে দণ্ডবৎ।।
তাহার রমণী পাগলেরে বড় মানে।
ভক্তিযুক্ত চিত্ত সদা
প্রাণতুল্য জানে।।
ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্র
শ্রীরাইচরণ।
জ্যেষ্ঠা কন্যা দেবীরাণী
শ্যামলা বরণ।।
পুত্র কন্যা পরিবার সবে
পুলকিত।
হরি হরি বলিতে শরীর
রোমাঞ্চিত।।
দিবানিশি প্রেমোন্মত্ত বলে
হরিবোল।
পাগলের জন্যে যেন হইল পাগল।।
পাগলে দেখিলে গললগ্নী
কৃতবাসে।
হরি বলে নাচে গায় পরম
হরিষে।।
অধিকারী ঠাকুরানীর কোলেতে
বসিয়া।
মাই খায় পাগল ডাকেন মা
বলিয়া।।
একদিন ঠাকুরানী সঙ্গেতে
পাগল।
নদীকূলে ঘাটে বসে বলে
হরিবোল।।
পাগল বলেছে মাগো হেন মনে লয়।
এই ঘাটে বসে যেন হ’য়ে যাই লয়।।
আর দিন অধিকারী সঙ্গেতে
আসিল।
নদীকূলে সেই ঘাটে পাগল
বসিল।।
পাগল বলেছে হ’ব এই ঘাটে লয়।
মনে ভাবি গঙ্গাদেবী লয় কিনা
লয়।।
বলা কহা করি অধিকারীর
সঙ্গেতে।
বলে আর ইচ্ছা নাই এদেশে
থাকিতে।।
সময় সময় মোর উঠে যে বেদনা।
অসহ্য হয়ে উঠে বেদনা যাতনা।।
বেদনায় এ শরীরে নাহি সহে
টান।
মনে বলে এইবার ত্যজিব পরাণ।।
এ সব বারতা তথা বলা কহা করি।
পরদিন পাগল চলিল নিজ বাড়ী।।
বাড়ী গিয়া জনে জনে বলিল
সবারে।
পশ্চিমে যাইব আমি ভেবেছি
অন্তরে।।
নবগঙ্গা নদী আমি বড়
ভালোবাসি।
এইবার যা’ব ফিরে আসি কিনা আসি।।
মধুমতী পূর্বাপর প্রতি ঘরে
ঘরে।
ভালোবাসা যত ছিল বলিল সবারে।।
সাতই বৈশাখ দিন ফুফুরা
আসিয়া।
অধিকারী ঠাকুরকে বাড়ী না
দেখিয়া।।
রাই দেবযানী আর মাতা
ঠাকুরানী।
সবাকারে পাগল বলিল মিষ্ট
বাণী।।
মনে মনে করিয়াছিলাম এই
ধার্য।
এই ঘাটে আমি করিতাম এক
কার্য।।
তাহা না হইল অধিকারী বাড়ী
নাই।
তোমাদের কষ্ট হবে পশ্চিমেতে
যাই।।
সকলে লইয়া নিশি বাঞ্চিলেন
প্রেমে।
নিশি ভোর করিল মাতিয়া
হরিনামে।।
তারাইল কবিগান করিল তারক।
সেই স্থানে উপনীত গোস্বামী
গোলোক।।
মেলা মিলিয়াছে তারাইলের
বাজারে।
সদলে তারক এল গান গাইবারে।।
একপালা হইয়াছে সাতই বৈশাখে।
আর একপালা হবে নয়ই তারিখে।।
গোলোক মাঝির বাড়ী বাসাঘর নিয়া।
প্রভাতে তারক আছে সেখানে
বসিয়া।।
রামধন কীর্তনিয়া
সূর্যনারায়ণ।
উত্তর পিঁড়ির পরে ব’সে দুইজন।।
তারক বসিয়া আছে উত্তরের ঘরে।
হরিনাম করিতেছে মৃদু মৃদু
স্বরে।।
মন গেছে ওঢ়াকাঁদি উড়িয়া
নগরী।
হরিচাঁদ পদভাবি বলে হরি
হরি।।
গোলোক মাঝির বাড়ী গোস্বামী
গোলোক।
একা আসিলেন সঙ্গে নাহি অন্য
লোক।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
হুহুঙ্কার করি এসে দাঁড়াল
পাগল।।
প্রতিবেশী লোক সব শুনিতে
পাইল।
পাগলে দেখিতে সবে দৌড়িয়া
এল।।
বসেছেন রামধন সূর্যনারায়ণ।
পাগলে দেখিয়া তারা বলে
দুইজন।।
পাগলে যেরূপ দেখি কৃশ কৃশ
কায়।
বেশীদিন বাঁচে হেন বিশ্বাস
না হয়।।
তারক সে কথা শুনি বলিল তখন।
বড় মর্মভেদী কথা কহিলে দু’জন।।
কথা শুনি গোস্বামী পাগল উঠে
ঘরে।
বসিলেন গিয়া তারকের
শয্যাপরে।।
তিনঘর বাড়ীতে দক্ষিণপোতা
খালি।
উত্তরের ঘর ছেড়ে দিয়াছে
সকলি।।
ঘর শূন্য পোতা আছে বর্ষ চারি
পাঁচ।
পোতাঘেরা বন ভাণ্ডি আসালীর
গাছ।।
তাহার দক্ষিণে আম কাঁঠালের
বৃক্ষ।
শাখা শাখা পল্লবে পল্লবে হ’য়ে ঐক্য।।
বৃক্ষের তলায় স্থান অতি
পরিষ্কার।
পল্লবের স্নিগ্ধ ছায়া
মৃত্তিকা উপর।।
কয়টি দোহার ছিল গাছের তলায়।
পাগলের ধ্বনি শুনি আসিল
তথায়।।
দেখিয়া পাগল বড় হরষিত অন্তর।
ঘর হ’তে আসিলেন তাদের গোচর।।
জয় হরি বল রে গৌর হরি বল।
নামে মহাধ্বনি করি উঠিল
পাগল।।
মেলা দেখা লোক যত পূর্বমুখ
ধায়।
পাগলে দেখিতে সবে সেই বাড়ী
যায়।।
গোলোক মাঝির দুই পুত্র আর
নারী।
পাগলে ঘেরিয়া তারা বলে হরি
হরি।।
পাগল মাঝিরে ধরি বলে মিত
মিত।
বল বল হরিনাম শুনিতে অমৃত।।
মাঝি বলে জেলেরে কেন বা বল
মিতা।
তুমি হর্তা কর্তা হও সকলের
পিতা।।
আমি মম নারী মেয়ে ছেলে গরু
ঘর।
তুমি এর কর্তা, এরা সকল তোমার।।
এই মম পুত্র কন্যা এই মম
নারী।
দিয়াছি তোমারে সব সমর্পণ
করি।।
এক কন্যা বালিকা এ দুটি
দুগ্ধ পোষ্য।
তুমি সকলের গুরু এরা সব
শিষ্য।।
মা নাই সংসার ভুক্ত আছেন
শাশুড়ি।
সন্তানের স্নেহে থাকে
গোলোকের বাড়ী।।
পাগলে ধরিয়া পাগলের পায় পড়ি।
ধূলায় লুণ্ঠিতা হ’য়ে যায় গড়াগড়ি।।
যারে পায় তারে ধরি করে
গড়াগড়ি।
এই মত পাগলামী করে দণ্ড
চারি।।
লম্ফ দিয়া পড়ে গিয়া ভিটার
উপর।
লতাপাতা ছিঁড়ে স্থান করে
পরিষ্কার।।
তাহা দেখি দলে যত দোহারেরা
ছিল।
সকলে ভিটার গাছ উঠাতে
লাগিল।।
পাগল কহিছে তোরা হরি বলে
নাচ।
আমি একা উঠাইব এ কয়টি গাছ।।
মুহূর্তেকে পরিষ্কার করিলেন
ভিটা।
মেয়েদের বলিলেন আন জলঝাঁটা।।
যাহাকে বলেন যাহা তারা করে
তাই।
লেপন করিল ভিটা মেয়েরা
সবাই।।
যারে পায় তারে ধ’রে আনিল সত্বরে।
লোক বসাইয়া দিল ভিটার উপরে।।
সকলে মিলিয়া বলে বল হরি বল।
তার মধ্যে ফিরে ঘুরে নেচেছে
পাগল।।
ভ্রমিতেছে প্রেমে মেতে না হয়
সান্ত্বনা।
এমন সময় পেটে উঠিল বেদনা।।
সবাই অস্থির চিত্ত দিবা
অবশেষ।
রাত্রিকালে কহে মোর বেদনা
বিশেষ।।
এ দিকে পড়িল ডাক কবির খোলায়।
পাগল বলেন গান করগে ত্বরায়।।
গান গায় সবে মিলে মেলার
বাজারে।
এক এক জন থাকে পাগল গোচরে।।
গান ভঙ্গ পরে সবে যাইয়া
বাসায়।
অবস্থা দেখিয়া সবে কাঁদিয়া
ভাসায়।।
হেনকালে হুঙ্কারিয়া পাগল
দাঁড়ায়।
গোবিন্দ মাঝির বাড়ী দৌড়াইয়া
যায়।।
তিনখানা গামছা করিয়া একত্তর।
গামছা ধরিয়া রাখে পেটের
উপরে।।
থালা এক পার্শ্বে রাখে পেটের
বাহির।
বলে অঙ্গ বেদনায় হ’য়েছি অস্থির।।
তারকেরে কহে থালে জল
ঢালিবারে।
দেখি তায় ব্যাথা মোর শীতল নি
করে।।
তখন তারকচন্দ্র বলে হরিবোল।
থালার উপরে ঢালে চারি ঘটি
জল।।
চারি ঘটি পরিমাণ দশসের জল।
থালার উপর শুষ্ক হইল সকল।।
বেদনায় যাতনায় অগ্নিতাপ উঠে।
সেই তাপে জল সব শুষ্ক হ’য়ে’ পেটে।।
গোস্বামীর বক্ষঃস্থল সাপুটে
ধরিল।
তারক সে গামছা উঠায়ে চিপাড়িল।।
জলবিন্দু না পড়িল গামছা
হইতে।
মৃতপ্রায় পাগলেরে রাখিল
শয্যাতে।।
বলিল গোবিন্দ মাঝি উপায় কি
হবে।
গোস্বামী মরিলে বল মরা কে
ফেলা’বে।।
তারক কহিছে ওরে হারাম জালিয়া।
মরিলে কি তোর বাড়ী যাবরে
ফেলিয়া।।
তোর বাড়ী লীলা সাঙ্গ করা
অসম্ভব।
ম’লে কি দেহ তোরে স্পর্শ করতে দিব।।
তোর এই বাড়ী ভরে কে করে
প্রস্রাপ।
গোস্বামী কহেন তোর বাক্য হ’ল পাপ।।
এতবলি গোস্বামী উঠিল
ক্রোধভরে।
দৌড়াইয়া গেল গোলোক মাঝির ঘরে।।
কহিছে গোলোক মাঝি আমার বাটীতে।
থাকুক গোস্বামী মোরা থাকিব
সেবাতে।।
দিবা গেল রাত্রি গেল হইল
প্রভাত।
গোস্বামী বলেন যাব তারকের
সাথ।।
জয়পুর ঘাট আমি বড় ভালবাসি।
ইচ্ছা হয় নবগঙ্গা নদী মাঝে
পশি।।
মনের যে কষ্ট মোর সব হবে
দূর।
এখন অবশ্য আমি যাব জয়পুর।।
তারকের পানে চাহি কহিছে
গোলোক।
তুমি যদি পুত্র মোর হইতে
তারক।।
তুমি যদি হইতে আমার পুত্রধন।
তা’হলে অনেক কার্য হইত সাধন।।
আমি আর তোমারে যে বলিব না
দাদা।
তারক বলিয়া আমি ডাকিব
সর্বদা।।
গোস্বামী কহে তারক আর কিবা
চাও।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক তুমি
পুত্র হও।।
তারক তারক বলি ডাকে বার বার।
এর মধ্যে দাদা বলে ডাকে আর
বার।।
উহু উহু করি তবে উঠিল
গোঁসাই।
ডাকিব তারক বলে তাহা মনে
নাই।।
ভাবি যে তারক বলে ডাকিব
সর্বদা।
মনে ভাবি পুত্র ভাব মুখে আসে
দাদা।।
ভুলক্রমে যাহা কহি তাতে নাহি
লাজ।
আমার আসন্ন কালে কর পুত্র
কাজ।।
হেনকালে সূর্যনারায়ণ কেঁদে
কয়।
আসন্ন সময় যদি ভাব মহাশয়।।
পুত্র আছে নিবারণ নারিকেল
বাড়ী।
এ সময় কি জন্য তাহারে এলে
ছাড়ি।।
দশরথ মহানন্দ আছে বর্তমানে।
পিতা হ’তে অধিক তাহারা সবে মানে।।
সেই দেশে জ্ঞাতি বন্ধু আছয়
প্রচুর।
তাহা ছাড়ি কি জন্য যাবেন
জয়পুর।।
গোঁসাই বলেন মোর জ্ঞাতিবন্ধু
নাই।
মনের মানুষ যেই তার সঙ্গে
যাই।।
গৃহিণী থাকিলে হয় গৃহস্থ
তাহারা।
কেবা কার পুত্র হয় কেবা কার
দারা।।
পুত্র বটে নিবারণ ভালোবাসি
মনে।
মোর পুত্র আমি তাহা বলিতে
পারিনে।।
আছে মহানন্দ দশরথ দু’টি ভাই।
এ সময় যাই যদি তাহাদের ঠাই।।
মহানন্দ আছে সেই একা কি
করিবে।
এত উপদ্রব একা কেমনে সহিবে।।
তাই মনে ভাবি সবে না বুঝিবে
ইহা।
জয়পুর যাইতে সেহেতু মনে
স্পৃহা।।
হরিচাঁদ তরাইবে এই ভব
সিন্ধু।
হরি মাতা পিতা ভ্রাতা পুত্র
জ্ঞাতি বন্ধু।।
বাসনা দেখিতে বড় তারকের মুখ।
জয়পুর গেলে আমি পাই বড় সুখ।।
এত বলি খেপাচাঁদ উঠিল
খেপিয়া।
কিসের বেদনা মোর গিয়াছে
সারিয়া।।
বাটী হ’তে আসিলেন ঘাটে দৌড়াইয়া।
খোয়া নায় প্রাতেঃ এসে উঠিল
লাফিয়া।।
লাফিয়া লাফিয়া যান সকল
গুরায়।
বলে আমি পারে যাই কে কে যাবি
আয়।।
পার হ’য়ে ক্ষণেক চলিল দ্রুতগতি।
ক্ষণেক হাঁটিয়া বলে নাহি
গতিশক্তি।।
চলিতে লাগিল শেষে অতি ধীরে
ধীরে।
বসিয়া পড়িল শেষে হোগলা
ভিতরে।।
ঘুমাইয়া পড়িলেন বনের ভিতরে।
তারকের উরু পাতি দিলেন
শিয়রে।।
ক্ষণ থাকি নিদ্রা অন্তে
উঠিয়া দাঁড়ায়।
ইতিনা গ্রামের মধ্যে দৌড়াইয়া
যায়।।
এক বৃক্ষতলে বসি কহিছে
গোঁসাই।
উঠে যাইবার শক্তি আর মোর
নাই।।
বেদনা উঠিল পেটে নাহি সরে
বাক্।
ফুলিয়া উঠিল পেট মধ্যে এক
চাক।।
তারক কহিছে তবে এস মোর কোলে।
জনম স্বার্থক করি দেশে যা’ব চলে।।
পাগলে করিয়া কোলে তারক চলিল।
গোঁসাই কহিছে মোর শ্বাস বন্ধ
হল।।
তারপর তারক গোলোকে নিল
স্কন্ধে।
বলে মোর মাথা ধরি থাকহ
আনন্দে।।
স্কন্ধে করি কিছু পথ চলিল
হাঁটিয়া।
গোঁসাই কহিছে যেন যাই শূন্য
হৈয়া।।
তাহা শুনি পাগলেরে ভূমে নামাইল।
সঙ্গে যত বস্ত্র ছিল পেটে
জড়াইল।।
কটির উপরে রাখিলেন উচ্চ করি।
গোস্বামীকে বসাইল তাহার
উপরি।।
অতি সাবধানে তারপরে বসাইয়ে।
হেলিয়া গোঁসাইজীকে পৃষ্ঠেতে
তুলিয়ে।।
হাঁটিয়া চলিল পৃষ্ঠপরে রাখি
ছাতি।
চলিছেন হরি বলি অতি
দ্রুতগতি।।
ইতিনা ছাড়িয়া যান করফার
মাঠে।
সম্মুখে মল্লিকপুর গ্রামের
নিকটে।।
হেনকালে পৃষ্ঠ হ’তে লম্ফ দিয়া পড়ি।
পুনঃলম্ফ দিল হরি বলে ডাক
ছাড়ি।।
হরি হরি বলিয়া মারিল
পুনঃলম্ফ।
পদভরে সেই স্থানে হৈল
ভূমিকম্প।।
দৌড়াইয়া যায় যেন ঘূর্ণ বায়ু
পাক।
দেখিয়া পথিক লোকে হইল অবাক।।
তারক দৌড়িয়া যায় উর্দ্ধমুখ হ’য়ে।
কোথায় গোস্বামী গেল না পায়
খুঁজিয়ে।।
বড়ই বিমর্ষ হ’য়ে লাগিল হাঁটিতে।
অন্য এক ভদ্রলোক এসে
নিকটেতে।।
সে বলিল এক ব্যক্তি অতি
দৌড়াদৌড়ি।
বলিল যাইব আমি তারকের বাড়ী।।
আসিতেছে তারক কহিও তার
স্থান।
লইয়া তিনটি আম্র যেন বাড়ী
যান।।
অমনি বাজারে গিয়া তিন আম্র ল’য়ে।
বাড়ী গিয়ে দেখে আছে গোস্বামী
বসিয়ে।।
অমনি দিলেন আম গোস্বামীর
ঠাই।
পাইয়া অমৃত ফল খাইল গোঁসাই।।
পাড়া হ’তে নারীগণে ডাকিয়া আনিল।
আত্মবন্ধু বর্গ যত মেয়েলোক
ছিল।।
তারক বসন গলে বিনয় করিয়া।
সবার নিকটে কহে কাঁদিয়া
কাঁদিয়া।।
যখন তোমরা পাও কাজে অবকাশ।
আসিয়া সকলে থেকো গোস্বামীর
পাস।।
পায় ধরি সবে এসে এখানেতে
তিষ্ঠ।
আমার গোঁসাই যেন নাহি পায়
কষ্ট।।
তারকের ভার্যা নাম চিন্তামণি
সতী।
বিধবা পিস্তত ভ্রাতৃবধূ
সরস্বতী।।
সাধনা নামিনী নব মণ্ডলের
কন্যা।
হরিচাঁদ ভক্তি পাত্রী সেবিকা
সুধন্যা।।
ধর্মনারায়ণের স্ত্রী ঈশানের
মাতা।
সীতানাথ মাতা প্রাণ কৃষ্ণের
বণিতা।।
দিনমণি তার নাম পাটনীর মেয়ে।
এইসব দিল পরিচারিকা করিয়ে।।
এই কথা বলিয়ে দিলেন জনে জনে।
অন্য অন্য যত মেয়ে আসে সেই
স্থানে।।
গোঁসাই যখন যাহা চাহিতে
আশায়।
মন জেনে যোগাইবা তোমারা
সবায়।।
যদি বল মন মোরা জানিব কেমনে।
নিপুণ করিয়া মন রাখিও চরণে।।
যদি মন নাহি জান যখন যা চায়।
জ বলিতে জল এনে দিও সে সময়।।
হুঁকা চাহিবারে যদি করেন
আশায়।
হুঁ বলিতে হুঁকা এনে দিও সে
সময়।।
তৈল চাহিবার যদি করেন মনন।
ত বলিতে তৈল এনে করিও
মর্দন।।
এই রূপে যখন যে দ্রব্য
চাহিবেন।
দিবা রাত্রি কাছে থাকি সকলে
দিবেন।।
এইরূপে সবে থাক গোঁসাই সেবায়।
রাত্রিকালে চারিজন সর্বক্ষণ
রয়।।
চিন্তামণি সরস্বতী তারক
সাধনা।
দিবারাত্রি সর্বকাল রহে
চারিজনা।।
কেহ আসে কেহ যায় কেহ উঠে
বসে।
কেহ নিদ্রাবশীভুতা চক্ষের
নিমিষে।।
বারশ ছিয়াশী সাল ঊনত্রিশে
বৈশাখ।
সকলকে বলে তোরা হরি বলে
ডাক।।
প্রভু বলে মোরে যদি ভালই
বাসিস।
আজ তোরা মোর কাছে কেহ না
আসিস।।
বৈকাল বেলায় দেড় প্রহর
থাকিতে।
সকলকে তুষিলেন সুমিষ্ট
বাক্যতে।।
আমার এ ঘর ছাড়ি অন্য স্থানে
যাও।
দূরে নহে নিকটে নিকটে সবে
রও।।
তাহা শুনি চারিজন রহে
স্থানান্তরে।
তাহার নিকটে রহে গোস্বামী যে
ঘরে।।
দক্ষিণের ঘর পরিষ্কার
পরিপাটী।
পশ্চিম দক্ষিণ দিকে বেড়া
আঁটাআঁটি।।
নূতন নির্মাণ ঘর দেখিতে
সুন্দর।
গোঁসাই দেখিয়া বলে এ ঘর
আমার।।
তোমার যে বড় ঘর ও ঘরে না
যাব।
এই ঘরে থেকে আমি ঠাকুর
দেখিব।।
সেই ঘরে গোস্বামীর শয্যা করে
দিয়া।
উত্তরের বেড়া দিল চাটাই
ঘেরিয়া।।
এগারই তারিখে জয়পুর আসিলা।
সেই দিন রহিলেন আম্রবৃক্ষ
তলা।।
বারই বৈশাখ দিনে সে ঘরে
প্রবেশে।
শুশ্রূষা করেন সবে মনের
হরিষে।।
বেদনা যখন উঠে হয়েন অস্থির।
দুঃখেতে সবার চক্ষে ঝরে
অশ্রুনীর।।
পাগল বলিল সবে ঘর হ’তে যাও।
যদি মোরে ভালোবাস মোর কথা
লও।।
ঘরের বাহিরে গেল যত নরনারী।
গুণ গুণ রবে সবে বলে হরি
হরি।।
কেহ বা নিকটে যায় গোস্বামী
দেখিতে।
হস্ত তুলে মানা করে নিকটে
যাইতে।।
উত্তরের বেড়ে বেড়া ঠেলিয়া
চাটাই।
হরি বলে ভূমি তলে পড়িল
গোঁসাই।।
সীতানাথ তাহা দেখি ডাক দিয়া
কয়।
পাগল ঢলিয়া পল এস কে কোথায়।।
অমনি তারক গিয়া দৌড়িয়া ধরিল।
জ্ঞানশূন্য অচৈতন্য কোলেতে
করিল।।
সান্ত্বনা করিব বলে ধরিল
যতনে।
অতি ধীরে কোলে করি আনিল
প্রাঙ্গণে।।
সীতানাথের জননী বলিল তখনে।
অচেতন পাগল দেখনা তুমি
কেনে।।
পাগলেরে হরি নাম করাও শ্রবণ।
এ বার গোঁসাই বুঝি ত্যাজিল
জীবন।।
যার যা উচিৎ তাহা করহ এখন।
উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম কর
সর্বজন।।
হেনকালে গোস্বামী দিলেন অঙ্গঝাঁকি।
হস্ত পদ লোম কেশ উঠিল চমকি।।
গোস্বামীর মুখ হ’তে উঠে এক জ্যোতি।
চিকমিক ঠিক যেন বিদ্যুতের
ভাতি।।
তারকের মুখে বুকে লাগিল সে
জ্যোতি।
আর শূন্যে উঠে মহানন্দ দেহে
স্থিতি।।
গোপাল নামেতে একজন লোক আসি।
কাষ্ঠ করে হৃষ্ট মনে হ’ল রাশি রাশি।।
তাহা দেখে সাধনা সে বলিল
অভীষ্ট।
কি কারণে তোমরা করেছ এত
কাষ্ঠ।।
গোস্বামীর অগ্নিকাষ্ঠ করা বড়
দায়।
এ কার্য করিতে মম মনে লাগে
ভয়।।
বেদনায় গোস্বামীর জ্বলে গেছে
দেহ।
একরূপ গোস্বামীর তাতে হ’ল দাহ।।
ল’য়েছে অগ্নির শেক ব্যথায় অস্থির।
তাতে আর এক দাহ হ’য়েছে শরীর।।
ঠাকুরের লীলাসাঙ্গ হ’ল যে অবধি।
সে দারুণ আগুনে পুড়েছে
নিরবধি।।
পোড়া দেহ পুনঃ কেন করিবা
দাহন।
নব গঙ্গা জলে দেহ, দেহ বিসর্জন।।
গঙ্গার কামনা পূর্ণ
গোস্বামীর আশা।
গঙ্গার শীতল উভয়ের
ভালোবাসা।।
মনে বলে এর যদি কর বিপর্যয়।
তোমার বিপদ হ’বে জানিও নিশ্চয়।।
কেহ বলে পরোয়ানা এসেছে
থানায়।
জলে কদাচার কিছু করা নাহি
যায়।।
জলেতে প্রস্রাব কেহ করিবারে
নারে।
মলত্যাগ করিলে চালান দেয়
ধরে।।
দুই তিন জনের হয়েছে জরিমানা।
নদীকূলে মরাদাহ করিবারে
মানা।।
জরিমানা তুচ্ছ কথা বড়ই আটক।
সাক্ষী বিনা হয় তার ছ মাস
ফাটক।।
তারা বলেন আমি পড়িয়া এসেছি।
খেয়াঘাটে বিজ্ঞাপন লেখা দেখিয়াছি।।
মরা জলে দিলে দুই মাস জেল
লেখা।
জরিমানা ছাড়া পঞ্চায়েত নেয়
টাকা।।
তাতে নাহি ভয় হয় হউক ফাটক।
এ কার্য হইলে মম জীবন
স্বার্থক।।
খুন কি ডাকাতি পরদারী হিংসা
চুরি।
তাতে জেল হলে কলঙ্কের ভয়
করি।।
গোস্বামীকে জলে দিয়া যাইব
ফাটকে।
স্বর্গ সুখ অনুভব করি সে
আটকে।।
দিব যদি এতে দিতে হয়
জরিমানা।
অক্লেশে করিব সহ্য পুলিশ
যাতনা।।
বলিল সাধনা দেবী ইহা যদি কর।
প্রভাতে লাগিবে টাকা কি আছে
যোগাড়।।
তারক কহিল যদি না থাকে
যোগাড়।
ঘর বেচি দিব নয় খাটিব চাকর।।
নগদ চল্লিশ আছে আর কিবা ভাব।
যদি আরো কিছু লাগে নৌকা
বেঁচে দিব।।
তাহা শুনি সাধনা কহিছে ভাল
ভাল।
শীঘ্র তবে গোস্বামীকে ঘাটে
লয়ে চল।।
তারক করিল কোলে পদ পড়ে ঝুলে।
সাধনা শ্রীপদ ধরি তুলে নিল
কোলে।।
গোস্বামীকে ঘাটে এনে নৌকা
পরে রেখে।
ঘৃত মেখে সলিতার অগ্নি দিল
মুখে।।
বৈশাখী পূর্ণিমা ঊনত্রিশে
শনিবার।।
গোস্বামীকে লয়ে গেল গঙ্গার
ভিতর।।
হেনকালে পূর্ণচন্দ্র গগনে
উদয়।
নিশিতে দেখায় যেন দীপ্তকার
ময়।।
গোধূলি উত্তীর্ণ রাত্রি
দন্দেক সময়।
দশ দণ্ড উপরেতে শশাঙ্ক উদয়।।
চন্দ্রিমায় নীলাকাশ চিত্র
বিচিত্রিত।
শ্বেত লাল সবুজ হরিদ্রা নীল
পীত।।
তার অধোভাগে হ’ল মেঘ গোলাকার।
নবগঙ্গা মধ্যে হ’ল ঘোর অন্ধকার।।
তার চতুর্দিকে জ্যোৎস্না
আলোময়।
মধ্যে অন্ধকার কিছু লক্ষ্য
নাহি হয়।।
তারকের কোলে গোস্বামীর পুত
দেহ।
পাঁছনায় বৈঠা বায় গোপাল
উৎসাহ।।
গোস্বামীর সিদ্ধ দেহ ছাড়িলেন
জলে।
বুড় বুড় শব্দ তাতে তুফান
উঠিলে।।
তার মধ্যে পাক হ’ল পাগলে লইয়া।
সেই পাকে গোস্বামীকে দিলেন
ছাড়িয়া।।
জল হাতে লয়ে দোঁহে দিল
করতালি।
হরি বলে মস্তক উপরে হাত
তুলি।।
এড়েন্দার হাটুরিয়া নৌকা
দুইখান।
লোক দুই নৌকায় নব্বই
পরিমাণ।।
হরিধ্বনি শুনিয়া তাহারা বলে
হরি।
জলে স্থলে সবে বলে হরি হরি
হরি।।
মেঘ গেল চন্দ্রমণ্ডলে শোভা
প্রকাশে।
দণ্ড অন্ধকার থাকি পূর্ব
শোভা হাসে।।
এদিকে শ্মশানে আছে কাষ্ঠের
পাঁজাল।
সাধনা কহিছে র’ল একটি জঞ্জাল।।
শ্মশানে থাকিলে কাষ্ঠ ভাল না
দেখায়।
কাষ্ঠ জ্বালাইয়া শীঘ্র এস
দুজনায়।।
তারক গোপাল দোঁহে নৌকা বেয়ে
গেল।
কূল দিয়া গ্রন্থ আর সাধনা
চলিল।।
কাষ্ঠেতে আগুন দিয়া বলে হরি
হরি।
দু’জন পুরুষ আর দুইজন নারী।।
দুই কূলে দেখা যায় লোক সারি
সারি।
জলে স্থলে সকলে বলেছে হরি
হরি।।
হেন মতে চারিজন আসিলেন
ঘরে।
মহোৎসব করিবেন কহে
গোপালেরে।।
গোস্বামীর হুঁকা যষ্ঠি জয়পুর
ছিল।
রজনী প্রভাতে ওঢ়াকাঁদি
পাঠাইল।।
সদ্য সদ্য মহোৎসব করিতে
বাসনা।
গোপালকে কহিলেন মনের কামনা।।
দুইটি পূজারী আর ট’লো ছয়জন।
ভেকধারী দ্বাবিংশতি বৈষ্ণব
সুজন।।
জয়পুর কৃষ্ণপুর নারায়ণদিয়া।
কুন্দসীর নমঃশূদ্র স্বজাতি
লইয়া।।
গোস্বামীর স্বর্গার্থে করেন
মহোৎসব।
হরিবোল বলিয়া ভোজন হ’ল সব।।
যত লোক পরিমাণ আয়োজন ছিল।
অভ্যাগত লোক তার দ্বিগুণ
হইল।।
দুইশত লোক পরিমাণ আয়োজন।
লোকের সমষ্টি হ’ল চারিশত জন।।
দুঃখী লোক অবশিষ্ট প্রসাদ
পাইল।
শতাধিক লোকের প্রসাদ বিলি হ’ল।।
রন্ধন হইল যে তণ্ডুল দুই মণ।
পরিতোষ পরিচ্ছন্ন হইল ভোজন।।
দক্ষিণা লইয়া সবে বিদায় হইল।
আয়োজন জিনিসের অর্ধ ফুরাইল।।
লীলা সাঙ্গ গোস্বামীর
ত্যজিয়া ভূলোক।
পুত্ররূপে মহোৎসব করিল
তারক।।
এই কার্য পরিচর্যা অন্য যত
কার্য।
গোপাল অধ্যক্ষ হয়ে করিল
সাহায্য।।
পূর্বেতে গোপাল বড় পাষণ্ড
ছিলেন।
এই সব কার্য অতি যত্নে
করিলেন।।
গোস্বামীর ক্রিয়া অন্তে হইল
প্রেমিক।
রসিকের ধর্ম লয়ে হইল রসিক।।
হরি বলে সাধুসঙ্গ করে
নিরবধি।
শেষে তার সরকার হইল উপাধি।।
সাধুনাম খ্যাত হৈল বৈষ্ণব
সমাজে।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
দেবী ঋষিমণিকে গোস্বামীর
দর্শনদান
পয়ার
গোস্বামীর লীলাসাঙ্গ বৈশাখ
ঊনত্রিশে।
মহোৎসব জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম
দিবসে।।
পরেতে দোসরা জ্যৈষ্ঠ মঙ্গল
বাসরে।
দেখা দিল গিয়া দশরথের
নারীরে।।
বাসুড়িয়া নিবাসী বিশ্বাস
দশরথ।
বহুদিন হইতে নিয়াছে হরিমত।।
গোলোকের প্রিয়ভক্ত
স্বপরিবারেতে।
পাগলামী সদা করিতেন সে
বাড়ীতে।।
দশরথ বিশ্বাসের বাড়ীর
দক্ষিণে।
পালানে বেগুন ক্ষেত্র
নির্মিত যতনে।।
ঋমণি নামিনী দশরথের রমণী।
ক্ষেত্রে গিয়া বেগুন তুলিছে
একাকিনী।।
গোস্বামীর রূপ চিন্তা হৃদয়
মাঝার।
হেনকালে গোস্বামী ছাড়িল
হুহুঙ্কার।।
গোস্বামীকে দেখে ধনী পূর্ণ
ভাবোদয়।
পদরজ শিরে ধরি ধরণী লোটায়।।
মা! মা! বলিয়া প্রভু বলিল
তাহারে।
যাত্রা করিয়াছি আমি গত
শনিবারে।।
অদ্য আমি বিলম্ব না করিব এখন।
ওঢ়াকাঁদি যাইবারে হইয়াছে
মন।।
ঠাকুরের লীলাসাঙ্গ হ’য়েছে যে দিনে।
সেই হ’তে ভ্রমি ঠাকুরের অন্বেষণে।।
যাত্রা করিয়াছি মাগো ভাবি
সেই পদ।
দেখিব কোথায় আছে বাবা
হরিচাঁদ।।
এদেশে বাবার ভক্ত আছে যত জন।
একপাক বাড়ী বাড়ী করিব
ভ্রমণ।।
এত বলি যাত্রা করে
দক্ষিণাভিমুখে।
ঋমণি দাঁড়ায়ে থাকে পাগলকে
দেখে।।
সে মেয়ে ভাবিল মনে আজকে
যাইবে।
এইরূপে আসে যায় আবার আসিবে।।
দুই দিন পরে পুনঃ সংবাদ
আসিল।
জয়পুরে পাগলের লীলাসাঙ্গ হ’ল।।
শুনিয়া মূর্ছিতা হ’য়ে পড়িল ঋমণি।
পাগলের জন্য যেন হ’ল পাগলিনী।।
পরে গঙ্গাচর্ণা গ্রামে পাগল
চলিল।
গঙ্গাধর বাড়ই তাহাকে দেখা
দিল।।
গঙ্গাধরে বলে আন তামাক
সাজিয়ে।
পরে কার্তিকের বাড়ী উঠিলেন
গিয়ে।।
কার্ত্তিক তামাক খেয়ে হুঁকা
থুয়ে যান।
পাগল আসিয়া সে হুঁকায় দিল
টান।।
পরে রাইচরণের বাড়ীতে উঠিল।
হেনকালে গঙ্গাধর হুঁকা ল’য়ে এল।।
কার্তিকে জিজ্ঞাসা করে প্রভু
গেল কই।
কার্তিকের স্ত্রী অম্বিকা
বলে গেল অই।।
আপনি তামাক খেয়ে রাখিলেন
হুঁকা।
ঘরে বসে তামাক খেলেন প্রভু
একা।।
তারপর পাগল মণ্ডল বাড়ী গেছে।
দেখ গিয়া মণ্ডলের বাড়ীতেই
আছে।।
হেনকালে সংবাদ আনিল একজন।
করেছেন জয়পুর লীলা সংবরণ।।
শুনিয়া কার্ত্তিক গঙ্গাধর
রামমোহন।
পাগল পাগল বলে ধরাতে পতন।।
সে হইতে কার্ত্তিক সে তামাক
সাজিয়ে।
নিত্য নিত্য রাখেন পাগলের
লাগিয়ে।।
পাগলের জন্যে সবে করে
হাহাকার।
কবি কহে নাহি পাবে খুঁজিলে
সংসার।।
No comments:
Post a Comment