মধ্যখণ্ডঃ
দ্বিতীয় তরঙ্গ
মধ্যখণ্ড
দ্বিতীয় তরঙ্গ
বন্দনা
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
জয় জয় হরিচাঁদ জয় কৃষ্ণদাস।
জয় শ্রী বৈষ্ণব দাস জয় গৌরী দাস।।
জয় শ্রী স্বরূপ দাস পঞ্চ সহোদর।
পতিত পাবন হেতু হৈলা অবতার।।
জয় জয় গুরুচাঁদ জয় হীরামন।
জয় শ্রী গোলোকচন্দ্র জয় শ্রী লোচন।।
জয় জয় দশরথ জয় মৃত্যুঞ্জয়।
জয় জয় মহানন্দ প্রেমানন্দময়।।
জয় নাটু জয় ব্রজ জয় বিশ্বনাথ।
নিজ দাস করি মোরে কর আত্মসাৎ।।
মহা সংকীর্তনে শমনাবির্ভাব
পয়ার
ঠাকুরের আগমন রাউৎখামারে।
হরি সংকীর্তন হয় প্রতি ঘরে
ঘরে।।
প্রভু সঙ্গে ফিরে ভক্ত সকল
সময়।
হাসে কাঁদে নাচে গায়
প্রফুল্ল হৃদয়।।
ওঢ়াকাঁদি হ’তে যান রাউৎখামার।
মাস পক্ষ সপ্তাহ থাকিয়া যান
ঘর।।
প্রভু অল্প সময় থাকেন নিজ
ঘর।
বেশী থাকে মল্লকাঁদি
রাউৎখামার।।
মল্লকাঁদি মৃত্যুঞ্জয় ভক্ত
শিরোমণি।
কাশীশ্বরী নাম ধরে তাহার
গৃহিণী।।
তাহার সেবায় বাধ্য প্রভু
অহর্নিশি।
প্রভু সেবা কার্য করে যেন
সেবাদাসী।।
দুই তিন দিন কিংবা সপ্তাহ
পর্যন্ত।
মৃত্যুঞ্জয় ভবনে থাকেন
শান্তি-কান্ত।।
মল্লকাঁদি রাউৎখামার দুই
গ্রামে।
থাকিতেন যতদিন সদামত্ত
প্রেমে।।
যে দিন থাকিত ঠাকুর যা’র আলয়।
তাহার হইত চিত্ত
প্রেমানন্দময়।।
আন কথা আন শব্দ না ছিল কেবল।
ঘরে ঘরে পরস্পরে সুধা
হরিবোল।।
কৃষিকার্য কৃষকেরা করে দলে
দলে।
সতত সবাই মুখে হরি হরি বলে।।
গৃহকার্য সমাধা করিত
দিবসেতে।
প্রভুর নিকট যেত সন্ধ্যার
অগ্রেতে।।
যে গৃহেতে ঠাকুরের ভোজন হইত।
হইত লোকের ঘটা দুই তিন শত।।
কৃষ্ণকথা হরিনাম সংকীর্তন
রঙ্গে।
সারারাত্রি কাটাইত ঠাকুরের সঙ্গে।।
এক ঠাই হ’য়ে লোক দুই তিন শত।
নাম সংকীর্তন রঙ্গে রাত্রি
কাটাইত।।
এই মত নাম গান হইত যে স্থান।
কেমনে যামিনী গত না থাকিত
জ্ঞান।।
কখন হইত ভানু উদিত গগণে।
ভাবে মত্ত তাহা না জানিত কোন
জনে।।
খেয়েছে কি না খেয়েছে তাহা
মনে নাই।
চৈতন্য হইয়া বলে দেও দেও
খাই।।
সময় সময় হেন হইত উতলা।
কেহ বলে ভাইরে ঘুচিল ভব
জ্বালা।।
কেহ বলে পেয়েছিরে মনের
মানুষ।
কেহ বা হুঁশেতে বলে কেহ বা
বিহুঁশ।।
গড়াগড়ি পড়াপড়ি জড়াজড়ি হয়।
কেহ কার গায় পড়ে কেহ বা
ধরায়।।
ঢলাঢলি ফেলাফেলি কোলাকোলি হয়।
ধরাধরি করি কেহ কাহারে
ফেলায়।।
কে বলে পড়িয়াছি আর উঠা নাই।
পড়িয়াছি ভব কূপে তুলে নেরে
ভাই।।
কেহ বলে কি শুনালি কহিলি
কিরূপ।
হরি প্রেম বাজারে কি আছে
ভবকূপ।।
কেহ বলে কি কহিলি হারাইলি
দিশে।
এসেছে দয়াল হরি ভব কূপ
কিসে।।
বীররসে কেহ করে বীরত্ব
প্রকাশ।
কেহ বলে শমনের লেগেছে তরাস।।
কেহ বলে ওরে ভাই আমি যে শমন।
মম ত্রাস নাই তার সার্থক
জীবন।।
কেহ বা প্রলাপ করে হইয়া
পুলক।
কেহ বলে কিসে তোর জনম
সার্থক।।
এতবলি কেহ ধরে শমনের চুল।
আজরে শমন তোরে করিব
নির্মূল।।
সে জন কহিছে ভাই মেরনা
আমারে।
কি দোষ করেছি আমি তোদের
গোচরে।।
যে জন করয় পাপ তারে দেই
সাজা।
পবিত্র চরিত্র যার তারে করি
পূজা।।
কোন জন বলে জম কি কহিলি কথা।
পতিতপাবন এল পাপ আছে কোথা।।
তুই না করিতি যম পাপীর তাড়ন।
তেঁই তোরে বেঁধেছিল লঙ্কার
রাবণ।।
রাবণ মারিয়া তোরে যে করে
উদ্ধার।
সেই প্রভু হরিচাঁদ দয়াল
অবতার।।
যে হরি করেছে তোর এত উপকার।
তার উপকার কিবা করিলি এবার।।
ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদ হয়েছে প্রকাশ।
পাপ তাপ দূরে গেল তিমির
বিনাশ।।
হরিনামে জয়ডঙ্কা বেজেছে
সংসারে।
এ দেশে পাতকী নাই নিবি তুই
কারে।।
কহিছে শমন যেবা করে হরিনাম।
তাহার শ্রীপদে মম অনন্ত
প্রণাম।।
গিয়াছে আমার গর্ব মেরনারে
ভাই।
কি দোষ করেছি আমি হরিভক্ত
ঠাই।।
এসেছে দয়াল হরি বলা’য়েছে হরি।
তোমাদের স্পর্শ হেতু হরিনাম
করি।।
উপকারী হই আমি অপকারী কিসে।
হরিভক্ত হয় মানুষ আমার
তরাসে।।
হরিভক্ত হয়ে কেন ধর মম চুল।
আমি হই হরিপদ ভজনের মূল।।
মম ডরে সবে করে সাধন ভজন।
হরিভক্ত রক্ষাকারী আমি
একজন।।
যে জন প্রভুর ভক্ত যুগেতে
যুগেতে।
অহৈতুকী হরিভক্ত বিনা
আকাংখ্যাতে।।
ব্রহ্মত্ব ইন্দ্রত্ব পদ
তুচ্ছ তার আগে।
আছি কিনা আছি আমি মনেও না
জাগে।।
তার সাক্ষী শুন ভাই পাণ্ডব
গীতায়।
কুন্তী যে প্রার্থনা করে
শ্রীকৃষ্ণের পায়।।
শ্লোক
স্বকর্মফলনির্দিষ্টাং যাং
যাং যোনীং ব্রজাম্যহম্।
তস্যাং তস্যাং হৃষীকেশ
ত্বয়ার্ভক্তির্দৃঢ়াস্ত্ত মে।।
পয়ার
কলিরাজ্যে পাপ কার্যে সবে হ’ত বশ।
আমার ভয়েতে কেহ না করে
সাহস।।
আমি যদি রাজ কার্যে না
থাকিরে ভাই।
হরিভক্ত চূর্ণ হ’ত পাপীদের ঠাই।।
এনেছি তুলসী দল মিশ্রিত
চন্দন।
ছেড়ে দেরে পূজি হরিচাঁদের
চরণ।।
হরিভক্ত সঙ্গে অদ্য হইব
মিলন।
করিব মধুর হরি নাম
সংকীর্তন।।
সবে বলে যম এসে কীর্তনে
মাতিল।
শমনের প্রতি ভাই হরি হরি
বলি।।
অপিচ বৃদ্ধার বাচনিক ও
মৃত্যু কন্যার আবির্ভাব
পয়ার
এ হেন কীর্তন হয় মৃত্যুঞ্জয়
বাড়ী।
দৈবে কোথা হতে এসে নাচে এক
বুড়ি।।
সে কহিছে যমভগ্নি আমি মৃত্যু
কন্যে।
এসেছি দয়াল বাবা দেখিবার
জন্যে।।
কর্ণেতে কলম দিয়া যমের
মহুরী।
সংকীর্তনে নৃত্য করে বলে হরি
হরি।।
দেখিব দয়াল হরি দু’নয়ন ভরি।
মুখে বলে হরি হরি হরি হরি
হরি।।
বৃন্দাবন রাউৎখামার
মল্লকাঁদি।
নবদ্বীপ ওঢ়াকাঁদি করজোড়ে
বন্দি।।
মহাভাবে এইরূপ প্রলাপাদি হয়।
তার মধ্যে দুইজন উঠিয়া
দাঁড়ায়।।
তারা কহে মোরা দোঁহে শমনের
দূত।
সান্দীপানি মুনিবংশ
ব্রাহ্মণের সুত।।
আর এক মেয়ে নাচে হ’য়ে প্রেম স্ফূর্তি।
বলে আমি যম ভার্যা নাম মোর
মূর্তি।।
যমপুরী শূন্য করি আসি
পুরিশুদ্ধ।
আমরা পূজিব হরিচাঁদ
পাদপদ্ম।।
শূন্যে থেকে দৈববাণী হইল
দৈবাৎ।
আবির্ভাবে হরিপদে করি
প্রণিপাত।।
কমলে পূজিব হরি শ্রীপদ কমল।
প্রেমানন্দে তোরা সবে হরি
হরি বল।।
রাউৎখামার মল্লকাঁদি দুই
গ্রাম।
এই মত মত্ত হ’য়ে করে হরিনাম।।
ক্রমে বন্যা বেগে চলে হ’ল ধন্য ধন্য।
উঁচু নীচু ভেদ নাই দেশ
পরিপূর্ণ।।
দিবা রাত্রি গত হয় হ’য়ে জ্ঞানশূন্য।
কীর্তন ছাড়িয়া লোক পাইল
চৈতন্য।।
আয়োজন দশ বিশ জনের রন্ধন।
শতেক দ্বিশত লোকে করিল
ভোজন।।
ঘরে কিংবা বাহিরে কি ঘাটে আর
পথে।
হরি বল হরি বল সবার মুখেতে।।
মনোভৃঙ্গে মধুপায়ী
শ্রীহরিপাদাব্জে।
পিপাসু তারকচন্দ্র কবি
রসরাজে।।
ভক্ত দশরথ বৈরাগীর উপাখ্যান
পয়ার
সাধুসুত দশরথ উপাধি বৈরাগী।
রাউৎখামারবাসী মহা অনুরাগী।।
প্রভু যবে লীলা খেলা করে এই
মতে।
এ সময় দশরথ প্রেমে যায়
মেতে।।
প্রভুর সঙ্গেতে ফিরে সেই
দশরথ।
হইলেন প্রভুর প্রিয় পরম
ভকত।।
প্রভু স্থানে আসে লোক হ’য়ে ব্যাধিযুক্ত।
প্রভুর আজ্ঞায় তারা হয়
ব্যাধিমুক্ত।।
তাহা দেখি মনে দুঃখী দশরথ
ভক্ত।
রোগাভক্ত প্রভুকে করয় বড়
ত্যক্ত।।
মনোদুঃখে দশরথ গিয়া
প্রভুস্থানে।
করজোড়ে নিবেদিল প্রভুর চরণে।।
বহু লোক রোগযুক্ত হ’য়ে বহু দেশে।
রোগমুক্তি পাইতে তোমার ঠাই
আসে।।
আত্মসুখী রোগাভক্ত
ব্যাধিমুক্তে তুষ্ট।
তাহাতে আমার মনে হয় বড়
কষ্ট।।
আমার মনের ইচ্ছা যত লোক
রোগী।
সবাকার রোগ ল’য়ে আমি একা ভোগী।।
ওহে দয়াময় হরি আজ্ঞা কর তাই।
সবাকার রোগ ল’য়ে একা কষ্ট পাই।।
রোগী না থাকিলে ভবে কেহ
আসিবেনা।
তোমাকে ওরূপ করে ত্যাক্ত
করিবেনা।।
অহৈতুক ভক্তিমান ভক্ত আছে
যারা।
প্রেমের পিপাসু হ’য়ে আসিবেক তারা।।
সেই সঙ্গে হ’বে সুখে প্রেম আলাপন।
দয়া করি বল নৈলে ত্যজিব
জীবন।।
প্রভু বলে দশরথ একি কথা কও।
সংসারের রোগ কি উঠায়ে নিতে
চাও।।
কর্মক্ষেত্র সংসারেতে কর্ম
মহাবল।
সকলেই পায় কর্ম অনুযায়ী ফল।।
তবে তোর বাঞ্ছাহেতু দিব তোরে
রোগ।
বার বছরের পরে হ’বে তোর ভোগ।।
পাইয়া প্রভুর আজ্ঞা হইল
সন্তুষ্ট।
বার বছরের পরে হ’ল তার কুষ্ঠ।।
ঠাকুর বলেন বাছা আর কিবা চাও।
সংসার ছাড়িয়া এবে ভিক্ষা করে
খাও।।
কতদিনে এইভাবে ভিক্ষায়
প্রবৃত্ত।
আজ্ঞামতে করে নিল অযাচক
বৃত্ত।।
একদা ঠাকুর তারে বলিল গোপনে।
ভিক্ষার্থে বেড়াও বাছা যেই
যেই স্থানে।।
চাহিয়া কহিয়া ভিক্ষা করনা
কখন।
হেঁটে যেতে সেধে দিলে করিও
গ্রহণ।।
তাই ল’য়ে সন্ধ্যাকালে নৌকায় আসিও।
তাহাই রন্ধন করি একবেলা
খেও।।
বর্ষা আর শরৎ হেমন্ত গত হ’লে।
পদব্রজে ভিক্ষা মেগে খাইও
সেকালে।।
বেড়াইও পদব্রজে ভিক্ষার
নিমিত্ত।
যাচিয়া না লইও এ অযাচক
বৃত্ত।।
বাকবন্ধ করিয়া থাকিবা ছয়মাস।
মারিলেও কিছু নাহি করিও
প্রকাশ।।
রাত্রিতে থাকিও এক গৃহস্থ
আলয়।
বাহিরে থাকিও এক কন্থা দিয়া
গায়।।
একমাত্র ডোর আর একটি কপিন।
খুলিও না পরিয়া থাকিবা
রাত্রিদিন।।
যে ডোর কপিন কন্থা করিবা
ধারণ।
অন্য বস্ত্র কন্থা না পরিবা
কদাচন।।
ছয়মাস গত হ’লে দিবসে বেড়াইও।
ভাবের ভাবুক হ’লে তার বাড়ী যেও।।
নিশিতে থাকিয়া তার সঙ্গে বল
কথা।
তাহা ভিন্ন অন্য কথা না কহিও
কোথা।।
দশরথ বলে যাহা ‘চাই দিলে তাই’।
প্রভু বলে ‘আমি তোর বাসনা পুরাই’।।
তোর যে ভাবনা আছে বহুদিন হ’তে।
ভাবিলে ভাবনা সিদ্ধি পারিলে
ভাবিতে।।
যে যাহা ভাবনা করে ঠাকুরের
স্থান।
অবশ্য অভীষ্ট পূর্ণ করে
ভগবান।।
মোর ঠাই যেই ইচ্ছা করে সেই
জন।
আমি তা জানিতে পারি সকল
কারণ।।
যে যাহা প্রার্থনা করে এসে
মম ঠাই।
সেই গীত আমি তার সাথে সাথে
গাই।।
কর্মকর্তা ফলভোগে না হ’য়ে কি যায়।
সুকর্ম দুষ্কর্ম ফল অবশ্যই
হয়।।
তা না হ’লে ঈশ্বরের ব্যবস্থা থাকেনা।
কিন্তু দৈবে সাধুসঙ্গ পায়
যেই জনা।।
তার কাটে কর্মসূত্র সাধুর
কৃপায়।
কর্মপাশ মুক্ত সেই দৈব
ভাগ্যে হয়।।
নিঃস্বার্থ ভাবেতে যেই পর
উপকারী।
অকামনা শুদ্ধ প্রেম তারে
ব্যাখ্যা করি।।
আত্মসুখে কর্ম করে তাকে বলি
কাম।
পরসুখে কর্ম করে ধরে প্রেম
নাম।।
মম কষ্ট ভেবে মম সুখের
নিমিত্তে।
তব ইচ্ছা সদা পর উপকার
অর্থে।।
শ্লোক
আলোচ্য সর্ব্বশাস্ত্রাণি
বিচার্য চ পুনঃ পুন।
ইদমের সুনিস্পন্নং ধ্যেয়ো
নারায়ণঃ সদা।।
পয়ার
ভাগবত তুমি তাহা জানিলাম
সত্য।
তোমার প্রেমেতে আমি হইনু
বিক্রীত।।
সর্বত্যাগী সর্বরোগী
সর্বভোগী যেই।
মাধুর্যের পাত্র মহাভাগবত
সেই।।
সর্ব ত্যাগ করে বাছা পরিলে
কৌপিন।
সর্ব ত্যাগ সর্বভোগী হ’লে উদাসীন।।
কি ব্যাখ্যা করিব তোরে নাহি
বলাবল।
কি ফল ব্যাখ্যিব তোরে নাহি
ফলাফল।।
শুনিয়া পড়িল সাধু দণ্ডবৎ
করি।
শ্রী হরি বলিয়া অম্নি করিল
শ্রীহরি।।
দশরথ বলে আমি বড়ই জঘন্য।
তব বাক্য সত্য আমি আজ হ’তে ধন্য।।
অযাচক বৃত্তি ভিক্ষা
প্রবৃত্ত হইল।
দেশে দেশে অইভাবে ভ্রমিতে
লাগিল।।
ভ্রমণ করেন ঠাকুরের আজ্ঞামত।
সেভাবে জীবিকা রক্ষা করে
অবিরত।।
ছেঁড়া কাঁথা গায় ডোর কৌপিন
পরিয়া।
ছেঁড়াকানি মস্তকেতে চিবরী
বান্ধিয়া।।
বাক বন্ধ অন্তরে জপিত
হরিবোল।
ভিক্ষা করিতেন করে করি
কমুন্ডল।।
মল্লকাঁদি ছিলেন বিশ্বাস
মৃত্যুঞ্জয়।
মল্লকাঁদি ছেড়ে কালী নগরে
উদয়।।
মাঝে মাঝে ঠাকুর আসেন
মল্লকাঁদি।
অনুক্ষণ মৃত্যুঞ্জয় যান
ওঢ়াকাঁদি।।
একদিন ঠাকুর বলেন
মৃত্যুঞ্জয়।
করগে কালীনগরে বসতি আশ্রয়।।
তাহাতে ত্যাজিয়া মল্লকাঁদির
বাসর।
ভিটা ছাড়ি করে বাড়ী সে
কালীনগর।।
দৈবযোগে একদিন সেই ভদ্রাসনে।
দশরথ উপনীত দিবা অবসানে।।
মৃত্যুঞ্জয় দশরথ
সূর্যনারায়ণ।
তার মধ্যে হইলাম আমি একজন।।
কহিতেছে দশরথ হরষিত মনে।
কল্য বাছা আমারে যে মেরেছে
যবনে।।
মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসিল কেমনে
মারিল।
হাসিতে হাসিতে সাধু কহিতে
লাগিল।।
ঠাকুরের কথা আছে কথা না
কহিব।
অযাচক বৃত্তি দ্বারা জীবন
রাখিব।।
আউচ পাড়া যুধিষ্ঠির বিশ্বাস
ভবনে।
উপস্থিত হইলাম দিবা অবসানে।।
বাক বন্ধ প্রভু আজ্ঞা কথা
নাহি বলি।
পাগল বলিয়া সবে হাতে দেয়
তালি।।
রাখালে জিজ্ঞাসা করে আসিয়া
নিকটে।
কথা নাহি বলি, তারা সবে মারে ইটে।।
রাখালের যন্ত্রণায় হইনু
অস্থির।
আমাকে দেখিতে পায় সেই
যুধিষ্ঠির।।
রাখালে তাড়িয়া দিয়া মোরে
ডেকে লয়।
তিনি কন এ কখন পাগল ত নয়।।
সেখানেতে ছিল রামকুমারের
ভগ্নী।
নড়াইল নিবাসী ভবানী নামিনী।।
তিনি ক’ন আমি চিনি পাগল নহেত’।
মোদের ওঢ়াকাঁদি ঠাকুরের
ভক্ত।।
যুধিষ্ঠির যত্ন করি করান
ভোজন।
শল্যান্ন ও দধি দুগ্ধ সঘৃত
ব্যঞ্জন।।
ভোজন হইল বেলা অপরাহ্ণ কালে।
প্রতিষ্ঠার ভয়ে আমি আসিলাম
চলে।।
দিন ভরি ভিক্ষা করি যাই
কলাবাড়ী।
সন্ধ্যাকালে গিয়াছিনু
মিয়াদের বাড়ী।।
ঠাকুরের বাক্য আছে গৃহে যেতে
মানা।
মিয়াদের বাড়ীতে কাছারী
একখানা।।
সেই বাড়ী যখন হইনু অধিষ্ঠান।
মেয়েরা সকলে বলে এল
ম্যাজমান।।
তাহারা বলিছে কাছারীতে ব’স এসে।
আমি বসে রহিলাম খেড়পালা
পাশে।।
মেয়েরা সকলে এসে সুধায় আমায়।
বাড়ী কোথা বল তব যাইবা
কোথায়।।
আমি নাহি কথা বলি হইয়া কাতর।
এক মিয়া বলে বেটা হবে বুঝি
চোর।।
দশ বার জনে ঘিরে করে
গণ্ডগোল।
কেহ চোর কেহ কহে বোবা কি
পাগল।।
ধর চোর মার চোর করে
হুড়াহুড়ি।
এক মিয়া এসে মোর টেনে ধরে
দাড়ি।।
মিয়া কহে হ্যারে চোরা কথা না
কহিলি।
গরু চুরি করিবারে বসিয়া
রহিলি।।
মিয়া মোর দাড়ি টেনে ধরিল
যখনে।
আমি চাই উঠে যেতে দাড়ি ধ’রে টানে।।
মিয়া বলে গরুচোর পালাইতে
চায়।
দাড়ি ছাড়ি ধরি চুল পৃষ্ঠেতে
কিলায়।।
কিল খেয়ে পালাইতে চাই
শীঘ্রগতি।
আর মিয়া এসে মোর পৃষ্ঠে মারে
লাথি।।
আর মিয়া এসে মোর দাড়ি
ছাড়াইল।
ঘাড়ঘুল্লা দিয়ে মোরে ঠেলিয়া
আনিল।।
সেই মোর গ্রীবা ধরে যবে দেয়
ঠেলা।
সে মিয়া কহিছে এর গলে দেখি
মালা।।
সে মিয়া কহিছে এর মালা মোটা
মোটা।
এ দেখি বৈরাগী এরে চোর বলে
কেটা।।
হাতে দেখি ভিক্ষা হাঁড়ি
তাহাতে চাউল।
ভিক্ষুক বৈরাগী হ’বে নেড়া কি বাউল।।
ইহাকে মারিতে মম হ’তেছে মমতা।
এত অপমান করি নাহি কয় কথা।।
কাহাকে মারিলি তোরা ধরে দাড়ি
চুল।
কাহাকে মারিলি তোরা হারে
নামাকুল।।
টানিয়া লইল মোরে বাড়ীর উপরে।
ফেলিয়া গায়ের কাঁথা দেখে দীপ
ধরে।।
এত যে মারিনু তবু হা হা হুঁ
হুঁ নাই।
এ কোন মহৎ হবে মনে ভাবি
তাই।।
চোর যদি কুষ্ঠ ব্যাধি কেন ওর
গায়।
এ ভাব ধ’রেছে কোন মহতের কথায়।।
রস পৈতৃকের ঘা দেখি যে গাত্র
ভরা।।
এই দায় ঠেকে বুঝি এই ভাব
ধরা।।
না জেনে আমারে মারে আরো করে
রোষ।
মনে মনে বলি হরি না লইও
দোষ।।
সংসারের দুঃখ দেখি লইয়াছি
রোগ।
মেয়াদের দোষ হ’লে মোরে দেও ভোগ।।
হেসে হেসে দশরথ এই কথা কয়।
তাহা শুনি হাসিয়া কহেন
মৃত্যুঞ্জয়।।
সাধে সেধে নিলে ব্যাধি হইলে
আতুর।
ঠাকুর পরীক্ষা করে সহ্য
কতদূর।।
এইভাবে দশরথ ভ্রমে ঠাই ঠাই।
রসনা বাসনা হরি হরি বল ভাই।।
দেবী জানকী কর্তৃক মহাপ্রভুর
ফুলসজ্জা
পয়ার
নিত্যানন্দ শ্রীচৈতন্য আর
শ্রীঅদ্বৈত।
তিন সহোদর হয় অতি সুচরিত।।
নিত্যানন্দ জ্যেষ্ঠা কন্যা
নামে কলাবতী।
চণ্ডীচরণের নারি অতি সাধ্বী
সতী।।
পদুমা নিবাসী রামমোহন
মল্লিক।
তাহার তনয় চণ্ডীচরণ নৈষ্ঠিক।।
নিত্যানন্দের আর এক কন্যা
রসবতী।
মৃত্যুঞ্জয়ের কনিষ্ঠা অতি
সাধ্বী সতী।।
গোবিন্দ মতুয়া প্রভু ভক্ত
শিরোমণি।
রসবতী সতী হয় তাহার ঘরণী।।
অষ্ট সাত্ত্বিক বিকারী
গোবিন্দ মতুয়া।
হরিনাম করিতেন নাচিয়া
নাচিয়া।।
প্রভাতী গাইত যবে প্রভাত
সময়।
শুনিয়া সবার চিত্ত হ’ত দ্রবময়।।
গোগৃহে থাকিত গরু ঊর্ধ্ব মুখ
চেয়ে।
নয়ন জলেতে তারা যাইত
ভাসিয়ে।।
পক্ষীগণ এসে সব উড়িয়া পড়িত।
বৃক্ষপরে পক্ষীগণ বসিয়া
শুনিত।।
পক্ষী সব দিত স্বর গানের
স্বরেতে।
জ্ঞান হ’ত পক্ষী গান করে সাথে সাথে।।
ভাস্কর উঠিলে শেষে গান ভঙ্গ
হ’ত।
পক্ষীগণ চিঁ চিঁ কুচি রবে
উড়ে যেত।।
হেন-ই গায়ক ছিল গোবিন্দ
মতুয়া।
নাচিত কীর্তনমাঝে যেমন
নাটুয়া।।
রসবতী সতীর কনিষ্ঠা সহোদরা।
সাধ্বী সতী সুকেশা সুন্দরী
মধুস্বরা।।
সবার কনিষ্ঠা ধনী জানকী
নামেতে।
তার বিয়া হ’ল গৌরচন্দ্রের সঙ্গেতে।।
শ্রাবণ মাসেতে বিকশিতা
কৃষ্ণকলি।
ফুল দেখে জানকী হইল
কুতূহলী।।
ভেবেছেন এই ফুল গেঁথে
বিনাসুতে।
এ হার দিতাম হরিচাঁদের
গলেতে।।
এমত জানকী দেবী মনেতে
ভাবিয়া।
ফুলপানে এক দৃষ্টে রহিল
চাহিয়া।।
দেখে ফুল প্রাণাকুল হ’লে উত্তরাক্ষ।
চক্ষের জলেতে তার ভেসে যায়
বক্ষ।।
অবসন্নমনা ফুল কাছে উপনীত।
মনে মনে কহে ফুল কেন
বিকশিত।।
প্রভু এলে তুই যদি বিকশিতা হ’তি।
তা’হলে প্রভুর গলে যাইতে পারিতি।।
অদ্য বিকশিত হ’লি কল্য হ’বি বাসি।
ঝরিয়া পড়িবি তুই জলে যাবি
ভাসি।।
পুস্পপানে চেয়ে র’ল না পালটে আঁখি।
পিছে হাঁটি পিছাইয়া চলিল
জানকী।।
ঘরের পিড়ির প’র বসিল তখনে।
আত্ম হারাইয়া চেয়ে আছে ফুল
পানে।।
তথা বসি মনে মনে গাঁথিলেন
হার।
ধবল লোহিত ফুল হরিদ্রা
আকার।।
তিন বর্ণে ফুল তুলে বর্ণে
বর্ণে গাঁথি।
থরে থরে গাঁথনি করিল সাধ্বী
সতী।।
চারি চারি সাদা ফুল চারি
চারি লাল।
চারিটি হরিদ্রা ফুলে করিয়া
মিশাল।।
এইভাবে পুস্পহার করিয়া
গ্রন্থন।
প্রভুর শ্রীকণ্ঠে দিল করিয়া
যতন।।
হরিচাঁদে ফুলসাজে সাজিয়া
জানকী।
মনোহর রূপ দেখে অনিমেশ
আঁখি।।
আরোপে শ্রীরূপ দেখে স্পন্দহীনা
রয়।
ঠিক যেন ধ্যান ধরা যোগিনীর
ন্যায়।।
প্রহরেক কালগত এরূপে বসিয়া।
এইভাবে একেশ্বরী আছেন
চাহিয়া।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়াছিল দক্ষিণ
পাড়ায়।
এসে গৃহে এইভাব দেখিবারে
পায়।।
সম্বোধিয়া কহে মৃত্যুঞ্জয়ের
রমণী।
প্রহরেক এইভাবে তোমার
ভগিনী।।
অঙ্গের স্পন্দন নাহি শ্বাস
আছে মাত্র।
চক্ষের নিমিষ নাহি যেন
শিবনেত্র।।
দক্ষিণাভিমুখ ছিল দণ্ড চারি
ছয়।
উত্তরাভিমুখ এই দণ্ড দুই
হয়।।
আহারান্তে ননদিনী ছিলেন শয়নে।
নিদ্রাভঙ্গে গিয়াছিল ফুলের
বাগানে।।
বিকশিতা কৃষ্ণকলি দেখিল
চাহিয়া।
ফিরে না আসিল গৃহে এল
পিছাইয়া।।
জানকীর সেই ভাব মৃত্যুঞ্জয়
দেখি।
উচ্চঃস্বরে ডাকে তারে জানকী
জানকী।।
চিৎকার ঈষৎ মাত্র শুনিল
জানকী।
জ্ঞান নাই অঙ্গে মাত্র দিল
এক ঝাঁকি।।
এক ডাক দুই ডাক তিন ডাক দেয়।
তিনবার অঙ্গ কম্প যোগ ভঙ্গ
নয়।।
সুভদ্রা কহিছে ডেকনারে
মৃত্যুঞ্জয়।
এ যেন কৃষ্ণ আরোপ হেন জ্ঞান
হয়।।
মৃত্যুঞ্জয় জানকীকে কহে কাঁদি
কাঁদি।
জানকীরে দেখ আমি যাই
ওঢ়াকাঁদি।।
ওঢ়াকাঁদি প্রভুধামে যান
মৃত্যুঞ্জয়।
উপনীত হ’ল গিয়া সন্ধ্যার সময়।।
ঘোর হয় নাই সন্ধ্যা দ্বীপ
জ্বলে ঘরে।
ঠাকুর বসিয়াছেন গৃহের
বাহিরে।।
প্রণমিল মৃত্যুঞ্জয় ঠাকুরের
পায়।
অপরূপ ফুলসজ্জা দেখিবারে
পায়।।
কৃষ্ণকলি পুষ্পহার প্রভুর
গলায়।
কি শোভা হয়েছে তাহা কহা নাহি
যায়।।
চারি চারি শ্বেত পুষ্প চারি
চারি লাল।
চারিটি হরিদ্রা বর্ণ তাহাতে
মিশাল।।
চারি পুষ্প শ্বেত আর চারি
পুষ্প লাল।
চারিটি হরিদ্রা বর্ণ থরে থরে
মাল।।
এই মালা দুই সারি প্রভুর
গলায়।
আর দুই সারি মালা দিয়াছে
মাথায়।।
মস্তকের পার্শ্ব দিয়া আকর্ণ
বেষ্টিত।
ঝুমুকা আকার হার গলেতে
দোলিত।।
এক সারি বক্ষঃপর রয়েছে
সাজান।
আর এক সারি নাভি পর্যন্ত
ঝুলান।।
অপরূপ তাহাতে হয়েছে কিবা
সাজ।
গোপীরা সাজায় যেন কুঞ্জ বন
মাঝ।।
ফুলহার ঈষৎ ঈষৎ ঝুলিতেছে।
তার মাঝে দলগুলি ঈষৎ লড়িছে।।
বহিতেছে মন্দ মন্দ দক্ষিণে
বাতাস।
ফুল হতে বহিতেছে অপর্যাপ্ত
বাস।।
এতেক শ্রাবণ মাস আরও
সন্ধ্যাকালে।
অল্পক্ষণ দিনমণি গেছে
অস্তচলে।।
আকাশে বিচিত্র শোভা স্থগিত
বরুণ।
এদিকে উদিত যেন দ্বিতীয়
অরুণ।।
মৃত্যুঞ্জয় এসে তাই করে
দরশন।
অপরূপ রূপ যেন মদন মোহন।।
জ্ঞানহারা প্রায় যেন হইল
অধৈর্য।
ভেবেছেন মৃত্যুঞ্জয় এই কি
নিকুঞ্জ।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে প্রভু বল বল
বল।
কোন গোপী ব্রজভাবে তোমাকে
সাজা’ল।।
প্রভু কন মল্লকাঁদি জানকী
নামিনী।
আমাকে সাজিয়ে গেল সেই যে
গোপিনী।।
তুমি যারে দেখে এলে যেন
ধ্যান ধরা।
উত্তার দেখিলে যার নয়নের
তারা।।
মানসেতে মনসুতে মালা গেঁথে
ফুলে।
মনে মনে মালা গেঁথে দিল মোর
গলে।।
আরোপেতে দেখে মোরে বাক্য
নাহি স্ফুরে।
এসেছ যাহার ভাব জানাতে
আমারে।।
কি কহিবি তার কথা বল বল বল।
দেখিব দেখিব তারে চল চল চল।।
মৃত্যুঞ্জয় ধরায় পড়িল কাঁদি
কাঁদি।
প্রভু বলে চল শীঘ্র যাই
মল্লকাঁদি।।
মহাপ্রভু নৌকা ‘পরে উঠিল অমনি।
আস্তে আস্তে মৃত্যুঞ্জয়
বাহিল তরণী।।
শুক্লাপক্ষ শুভাস্টমী তিথির
সময়।
তরী পরে হরি, তরী বাহে মৃত্যুঞ্জয়।।
ক্রমে ক্রমে নিশাকর কর
প্রকাশিল।
ঈশানে ঈষৎ মেঘ ক্রমে দেখা
দিল।।
গগনে নক্ষত্র সব হ’য়েছে উদয়।
তার মধ্যে চন্দ্রোদয় কিবা
শোভা তায়।।
শোভা দেখি মৃত্যুঞ্জয় আনন্দ
অপার।
জয়ধ্বনি করে ক্ষণে করে
হুহুঙ্কার।।
স্বেদকম্প পুলকিত মৃত্যুঞ্জয়
দেহ।
বলে তোরা হেন শোভা দেখিলি না
কেহ।।
বিস্মিত হইল ঠাকুরের পানে
চেয়ে।
প্রভু কয় যারে বাছা ত্বরা
তরী বেয়ে।।
ধীরে ধীরে বাহে তরী মালা
দেখি মোহে।
নিরখি নিরখি নীর নিরবধি
বহে।।
বহিতেছে বাহিতেছে মোহিতেছে
মালা।
উপনীত হল আসি খাল তালতলা।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়াছেন উড়িয়া
নগরী।
আশাপথ চেয়ে তার নারী
কাশীশ্বরী।।
নিবাসী নিশ্চিন্তপুর তপস্বী
সদ্জ্ঞানী।
দেবী কাশীশ্বরী তার প্রাণের
নন্দিনী।।
মৃত্যুঞ্জয় গিয়াছেন যেই পথ
দিয়া।
ঠাকুরানী সেই পথে আছেন
বসিয়া।।
প্রাণকান্ত গিয়াছেন
প্রাণকান্ত স্থানে।
ভাবে কান্ত হেরি কান্ত আসে
কতক্ষণে।।
ক্ষণেক বসিয়া থাকে
উত্তরাভিমুখে।
ক্ষণে গৃহকার্য করে পুনঃ
গিয়া দেখে।।
গৃহকার্য করি যায় গৃহের
বাহিরে।
পুনঃ গৃহ পিছে এসে আশাপথ
হেরে।।
আবার আসিয়া গৃহকার্য করে
ক্ষণে।
ক্ষণে ক্ষণে দৃষ্টি করে
জানকীর পানে।।
নিভৃতে বসিল গিয়া গৃহের
পশ্চাতে।
আসে কিনা আসে নাথ দেখে
আরোপেতে।।
নয়ন মুদিয়া প্রায় অর্ধদণ্ড
ছিল।
আরোপে দেখিল প্রভু তালতলায়
এল।।
হর্ষোৎফুল্ল হইয়া উঠিল
ঠাকুরানী।
সত্বরে আসিল যথা যোগে
ননদিনী।।
কহে ডাকি সে জানকী ননদীর
ঠাই।
ঠাকুর এসেছে তোর আর চিন্তা
নাই।।
কতক্ষণ এইরূপে আরোপে থাকিবা।
অনুমান ছাড়ি কর বর্তমান সেবা।।
কৃষ্ণকলি হার শোভে ঠাকুরের
গলে।
সুখে হাতে সৌদামিনী জলদের
কোলে।।
বার বার ডাকিতেছে উঠ
ঠাকুর-ঝি।
ঠাকুর ঠাকুর ল’য়ে ওই এল বুঝি।।
মৃত্যুঞ্জয় মাতা সে সুভদ্রা
ঠাকুরানী।
করিছেন মালা জপ বসি
একাকিনী।।
কহিছে বধূর কাছে তোরা কোহিস।
ঠাকুর এসেছে কথা কোথা কি
শুনিস।।
বধূ কহে ঠাকুরানী কি কোহিব
আর।
ঠাকুর-ঝি গাঁথিয়াছে মালা
মনোহর।।
সেই মালা গলে কিবা সেজেছে
ঠাকুরে।
অই আসিতেছে নৌকা আর নাহি
দূরে।।
হেন মতে হইতেছে কথোপকথন।
মল্লকাঁদি ঘাটে নৌকা আসিল
তখন।।
ভকত বৎসল হরি দ্বৈত হরি
রূপে।
ইচ্ছিলেন আসিবেন জানকী
সমীপে।।
অসম্ভব ক্রিয়া যত তাহাতে
সম্ভব।
প্রহ্লাদে রাখিতে যথা
স্তম্ভেতে উদ্ভব।।
এক কৃষ্ণ যথা নন্দ গৃহে বন্ধ
রয়।
আর কৃষ্ণ কণ্ব মুনি অন্ন
মেরে দেয়।।
এক মূর্তি মৃত্যুঞ্জয়
নৌকাপরে থাকি।
এক মূর্তি দেখে সুখে সুভদ্রা
জানকী।।
ঠাকুরের কথা শুনি সুভদ্রা
জননী।
বধূকে কহিল বধূ কহিলি কি
বাণী।।
জানকী দিয়াছে মালা ঠাকুরের
গলে।
দেখিলি সে মালা তুই তোর
ভক্তি বলে।।
তোরা দোঁহে মালা দিয়া কৈলী
দেখাদেখি।
আমি অভাগিনী শুধু মালা লয়ে
থাকি।।
হেনরূপ হইতেছে কথোপকথন।
উপস্থিত হরিচাঁদ হইল তখন।।
জানকী আসিয়া প্রভু পদে
প্রণমিল।
কাশীমাতা গৃহে গিয়া আসন
পাতিল।।
গললগ্নী কৃতবাস হইয়া তখনে।
প্রভুকে বলেন বাপ এস হে
আসনে।।
শুনিয়া ঠাকুর গিয়া আসনে
বসিল।
সুভদ্রা আসিয়া পদে প্রণাম
করিল।।
করজোড়ে কহিলেন ঠাকুরের ঠাই।
কি দিয়া জানকী তোমা সা’জাল গোঁসাই।।
ঠাকুর কহিছে তুমি জানিলে
কিরূপে।
সুভদ্রা কহিছে বধূ দেখিল
আরোপে।।
বধূ কহে হরিচাঁদে সাঁজালে
যতনে।
পদ্ম দিয়া পাদপদ্ম সাঁজালে
না কেনে।।
বলাবলি উভয়েতে করে ঠারে
ঠোরে।
তাই শুনি আমি শেষে জিজ্ঞাসি
বধূরে।।
বধূ বলে জানকী যে আরোপেতে
ছিল।
কৃষ্ণকলি ফুলহারে তোমারে
সাঁজিল।।
এই সেই ফুলহারে সাঁজিলে
গোঁসাই।
তব গলে মালা দেখি মানিলাম
তাই।।
ওদিকে প্রভুকে ল’য়ে আসেন মৃত্যুঞ্জয়।
মল্লবিলে পদ্মপুষ্প দেখিবারে
পায়।।
ভাবিছেন প্রভুকে লইয়া নিজ
ঘরে।
এই পদ্ম ফুল দিয়া সাজা’ব ঠাকুরে।।
পদ্মবনে ফুল তোলে বসিয়া
নৌকায়।
মহাপ্রভু বলে কি করিস
মৃত্যুঞ্জয়।।
মনের মানসা ফুল করিয়া যতন।
চন্দন মাখিয়া ফুলে পূঁজিব
চরণ।।
মৃত্যুঞ্জয় ভবনেতে বসিয়া
আসনে।
অন্তর্যামী গোঁসাই ভেবেছে
মনে মনে।।
কাশীমাতা হরিচাঁদে বসায়ে
শয্যায়।
চরণে চন্দন দেন আনন্দ হৃদয়।।
হেনকালে মৃত্যুঞ্জয় আনিলেন
ফুল।
ফুল দেখে কাশীমাতা আনন্দে
আকুল।।
চন্দনে মাখিয়া পদ্ম দেন পাদপদ্মে।
তুলসীর দাম দেন তার মধ্যে
মধ্যে।।
দেবী কাশী হাসি হাসি কহিছেন
বাণী।
ঠাকুরের শোভা কিবা দেখে
ঠাকুরানী।।
শুনিয়া সুভদ্রা মাতা
একদৃষ্টে চায়।
দ্বিগুণ উজ্জ্বল শোভা
দেখিবারে পায়।।
একে জানকী দত্ত আরোপের মাল।
পাদপদ্মে পদ্ম ভক্তি চন্দন
মিশাল।।
স্ফটিকের উপরে যেন হীরকের
চাকা।
চূড়ার উপরে যেন ময়ূরের
পাখা।।
দেখি ঠাকুরানী পড়ে পদে
লোটাইয়া।
মৃত্যুঞ্জয় পড়িলেন চরণ
ধরিয়া।।
জানকী পতিতা পদে কাঁদিয়া
কাঁদিয়া।
প্রেম-বন্যা উথলিয়া চলিল
বহিয়া।।
কাশীশ্বরী সবে তোলে ধরিয়া
ধরিয়া।
ঠাকুর বলেন সবে লহ উঠাইয়া।।
সকলে বসিল এসে ঠাকুরের ঠাই।
মহাপ্রভু পদধরি কাঁদিছে
সবাই।।
এ সময়ে মৃত্যুঞ্জয় প্রেমেতে
মাতিয়া।
হরি হরি হরি বলে নাচিয়া
নাচিয়া।।
মহাপ্রভু বলে আয় আয়
মৃত্যুঞ্জয়।
আমরা এখানে তুই নাচিস
কোথায়।।
এত শুনি মৃত্যুঞ্জয় নৃত্য
সম্বরিল।
শ্রীহরির শ্রীপদে শ্রীপাদ
লোটাইল।।
ক্রমে ক্রমে সকলেই প্রেম
সম্বরিল।
ফুলের বাগান দিকে নজর পড়িল।।
সন্ধ্যাগ্রে দেখিছে ফুল শাখা
পরিপূর্ণ।
এবে দেখে ফুল নাই শাখা সব
শূন্য।।
ফুল ছিল বাগানেতে ঘেরা
পরিপাটী।
এবে দেখে মাঝে মাঝে দুটি কি
একটি।।
এসে গৃহে মৃত্যুঞ্জয় কহিছেন
বাণী।
ধন্য মাতা ধন্য পিতা ধন্য
মোর ভগ্নী।।
মাতা মোর রত্নগর্ভা যে গর্ভে
ভগিনী।
হেন গর্ভে অগ্রে আমি তাহে
ধন্য মানি।।
যে গৃহে অনাথ নাথ গৃহ ধন্য
মানি।
যে গৃহে তোমাকে সেবে ধন্য সে
গৃহিণী।।
তব পাদপদ্মে প্রভু এই ভিক্ষা
চাই।
জনমে জনমে তোমা এইরূপে পাই।।
ঠাকুর বলেন বাছা তুইরে সাধক।
জনমে জনমে তুই আমার সেবক।।
যাবচ্চন্দ্র দিবাকর জনমে
জনমে।
তব প্রেমে বাধ্য আমি তোমার
আশ্রমে।।
মৃত্যুঞ্জয় বলে প্রভু আর
নাহি চাই।
অহৈতুকী ভক্তি যেন জন্মে
জন্মে পাই।।
জানকী আরোপ মনোরম্য ফুলসাজ।
কহিছেন তারকচন্দ্র কবি
রসরাজ।।
মৃত্যুঞ্জয়ের কালীনগর বসতি
পয়ার
মল্লকাঁদি গ্রাম্য জমি হয়ে
গেল জলা।
উর্বরা যতেক জমি হইল অফলা।।
গ্রাম মাঝে কৃষিকার্য করিত
যাহারা।
নানারূপ বাণিজ্যাদি করিল
তাহারা।।
হরিচাঁদ বলে শুন ওরে
মৃত্যুঞ্জয়।
এ দেশে অজন্মা হ’ল কি হবে উপায়।।
সকলে বাণিজ্য করি হইল
ব্যাপারী।
তুমিত বেড়াও শুধু বলে হরি
হরি।।
জননী তোমার হয় পরমা বৈষ্ণবী।
কিসে হবে মাতৃসেবা মনে মনে
ভাবি।।
গৃহস্থের গৃহকর্ম রক্ষা
সুবিহিত।
কর্মক্ষেত্র গৃহকার্য করাই
উচিত।।
ভার্যা তব সাধ্বী সতী অতি
পতিব্রতা।
কার্য কিছু না করিলে খেতে
পাবে কোথা।।
তুমি যাও মধুমতি নদীর ওপার।
দিনকতক থাক গিয়া বাছারে আমার।।
থাকগে চণ্ডীচরণ মল্লিকের
বাড়ী।
জমি রাখ ধান্য পাবে কৃষিকার্য
করি।।
মম অন্তরঙ্গ ভক্ত হবে সে
দেশেতে।
তোমারে করিবে ভক্তি একাগ্র
মনেতে।।
হরিনাম সংকীর্তন কর দিবা
রাত্রি।
তাহা হলে সবে তোমা করিবেক
ভক্তি।।
কোকিলা নামিনী রাম সুন্দরের
কন্যা।
পদুমা নিবাসী দেবী নারীকুল
ধন্যা।।
রামসুন্দরের ভার্যা তিনকড়ি
মাতা।
সে বৃদ্ধা পরমা ধন্যা সতী
পতিব্রতা।।
গিয়াছিল ক্ষেত্রে জগন্নাথ
দরশনে।
জগন্নাথ রূপ তার লাগিল
নয়নে।।
জগবন্ধু বলি সদা করিত রোদন।
দেশে এল জগবন্ধু করি দরশন।।
ভোর রাত্রি শুকতারা করি
দরশন।
তখন হইত প্রেম ভাব উদ্দীপন।।
সূর্যোদয় অষ্ট সাত্বিক ভাবের
উদয়।
স্বেদ পুলকাশ্রু কম্প রৌদ্র
বীর ভয়।।
কাঁদিতে কাঁদিতে বৃদ্ধা হয়েন
উন্মত্তা।
উত্তার নয়ন হন ধরাতে
লুণ্ঠিতা।।
প্রভাতে উদিত হ’ল তরুণ তপন।
দেখেন জগবন্ধুর শ্রীচন্দ্র
বদন।।
সেই রত্নগর্ভ জাতা
শ্রীকোকিলা দেবী।
সতী অংশে জন্ম সেই পরমা
বৈষ্ণবী।।
মায়ে ঝিয়ে তাহারা তোমার ভক্ত
হবে।
আত্ম স্বার্থ ত্যজি তোমা
ভকতি করিবে।।
তাহা শুনি হৃষ্টচিত্তে কহে
মৃত্যুঞ্জয়।
যে আজ্ঞা তোমার প্রভু যাইব
তথায়।।
একামাত্র গেল পদুমায়
মৃত্যুঞ্জয়।
চণ্ডীচরণের বাটী হইল উদয়।।
বৎসরেক পদুমায় থাকিলেন গিয়া।
নিরবধি হরিগুণ বেড়ান
গাহিয়া।।
দিবা মধ্যে প্রহরেক গৃহকার্য
করে।
হরি কথা কৃষ্ণ কথা গোষ্ঠে
কাল হরে।।
ঠাকুরের যুগধর্ম করিল
প্রচার।
ক্রমে সব লোক ভক্ত হইল
তাহার।।
সবে বলে আপনাকে যেতে নাহি
দিব।
আমরা সেবক হয়ে এদেশে রাখিব।।
পূর্বে প্রভু শ্রীমুখে
করিয়াছি ব্যক্ত।
সমাতৃক কোকিলা হইল তার
ভক্ত।।
হরিনাম মহামন্ত্র জপে
নিরবধি।
অল্পদিনে কোকিলার হইল বাকসিদ্ধি।।
পদুমা আইচপাড়া শ্রীকালীনগর।
প্রভুর ভাবেতে সবে হইল
বিভোর।।
কোকিলাকে ভক্তি করে এ দেশে
সবায়।
কোকিলার দোঁহাই দিলে ব্যাধি
সেরে যায়।।
ওলাওঠা বিসূচিকা জ্বর
অতিসার।
রসপিত্ত আর দ্ব্যাহিক
ত্রাহ্যিক জ্বর।।
থাকেনা তাহার ব্যাধি অমনি
আরাম।
মহাব্যাধি সারে নিলে কোকিলার
নাম।।
রোগী শোকী ভোগী যত জ্ঞানী কি
অজ্ঞানী।
কোকিলাকে ডাকে সবে মাতা
ঠাকুরানী।।
বৎসরেক হরিনাম করিয়া প্রচার।
মৃত্যুঞ্জয় রহিলেন সে
কালীনগর।।
সকলে সাহায্য করি তুলে দিল
ঘর।
ঠাকুর করহ বাস ইহার ভিতর।।
কাশীশ্বরী ভার্যা তার
সুভদ্রা জননী।
দোঁহে আছে মল্লকাঁদি যেন কাঙ্গালিনী।।
মৃত্যুঞ্জয় ওঢ়াকাঁদি যাতায়াত
করে।
মাঝে মাঝে দেখা দেয় সুভদ্রা
মায়েরে।।
কাশীশ্বরী মৃত্যুঞ্জয়
সুভদ্রা সুমতি।
তিনজন প্রভুর সেবায় আছে
ব্রতী।।
মহাপ্রভু আজ্ঞা দিল তাহাদের
প্রতি।
সকলে কালীনগরে করগে বসতি।।
অদ্য নিশি গতে কল্য প্রভাত
সময়।
শুভক্ষণে কর যাত্রা বুধের
উদয়।।
প্রভু আজ্ঞা শিরে ধরি অমনি
চলিল।
আসিয়া কালীনগর বসতি করিল।।
গোঁসাই কালীনগর বসতি বিরাজ।
রচিল তারকচন্দ্র কবি রসরাজ।।
শ্রীগোলক গোস্বামীর গোময়
ভক্ষণ প্রস্তাব
দীর্ঘ ত্রিপদী
মৃত্যুঞ্জয়ের জননী
দেবী সুভদ্রা নামিনী
সদা করে নাম সংকীর্তন।
গৌর নিত্যানন্দ বলে
ভাসে দু’নয়ন জলে
ডাকে কোথা শচীর নন্দন।।
নিদ্রাতে হ’য়ে বিভোরা বাপরে নিতাই গোরা
ডাকিতেন নয়ন মুদিয়া।
নিদ্রাযোগে অঙ্গে ঝাঁকি
ছল ছল দুটি আঁখি
কাঁদিতেন চৈতন্য হইয়া।।
হায় হায় কি হইল
দেখা দিয়া লুকাইল
বাপরে আমার নিত্যানন্দ।
ওরূপ করিত যবে
রামাগণ এসে তবে
প্রতিবাসী বলিতেন মন্দ।।
কোন কোন নারী আসি
বলিতেন হাসি হাসি
বাপ বল কোন নিতাইরে।
বলিত সুভদ্রা ধনী
আমার নিতাই মণি
সবাকার বাপ এ সংসারে।।
কেহ বলে জানি আমি
নিতাই তোমার স্বামী
রমণী কি স্বামী নাম লয়।
কহ বাবা নিত্যানন্দ
তাহাতে পরমানন্দ
নিতাই কি তব বাবা হয়।।
কহে সুভদ্রা বৈষ্ণবী
আমি নিতাই বল্লভী
নিত্যানন্দ জীবন বল্লভ।
নিত্যানন্দ দাসী আমি
নিত্যানন্দ মম স্বামী
যাহা হতে জগৎ উদ্ভব।।
নিতাই আমার বাপ
মাতৃবাপ পিতৃবাপ
পুত্রের কন্যার বাপ হয়।
জগৎ জনার বাপ
মোর বাপ তোর বাপ
তারে বাপ বলিতে কি ভয়।।
তোরা সব প্রতিবাসী
করিস কি হাসাহাসি
নিত্যানন্দ দাসী হই আমি।
নিতাই জগৎগুরু
প্রেমদাতা কল্পতরু
নিত্যানন্দ বাপ ভাই স্বামী।।
হেনভাবে সর্বক্ষণ
প্রেমাবিষ্ট তনু মন
নিত্য কৃত প্রাতঃস্নান আদি।
অরুণ উদয়কালে
স্নান ক’রে কুতূহলে
নিত্য লেপে তুলসীর বেদী।।
একদা সকাল বেলা
লইয়া গোময় গোলা
ঝাঁটা শলা দক্ষিণ করেতে।
লেপিছে বাহির বাড়ী
বাম করে গোলাহাঁড়ি
হরি হরি বলেন মুখেতে।।
এ হেন সময়কালে
জয় হরি বল বলে
গোঁসাই গোলোক উপনীত।
দেখিলে সকল লোকে
পাগল বলে তাহাকে
ভক্ত ওঢ়াকাঁদি ভাবাশ্রিত।।
মলিন বসনধারী
অঙ্গে কাঁথা বলে হরি
প্রণমিল সুভদ্রার পায়।
গোময়ের গোলা পদে
গোঁসাই মনের সাধে
পদরজ চাটিল জিহ্বায়।।
কহিছে সুভদ্রা ধনী
আমি বড় ঠাকুরানী
তুই বড় ভক্তি জানিস।
করিস কি ভারি ভুরি
মানিনে ও সাধুগিরি
কি বুঝিয়া আমাকে মানিস।।
ওঢ়াকাঁদি হরিচাঁদ
যিনি বৃন্দাবন চাঁদ
গৌর নিতাই চাঁদ যেন।
তার দায় দিয়া ফের
ভা’বো হ’য়ে ভাব
ধর
মেয়েদের পদ চাট কেন।।
কাঁথাখানি দিয়া গায়
হেঁটে বেড়ালে কি হয়
ভাব যে ঠাকুর হইলাম।
খাও মেয়েদের এঠে
মেয়েদের পদ চেটে
অষ্ট অঙ্গে করহ প্রণাম।।
আয় দেখি মোর ঠাই
দেখি কেমন গোঁসাই
কতদূর ভাবেতে বিভোলা।
পদ চাটি কাঁদা খালি
এনেছি গোময় গুলি
খা দেখি এ গোময়ের গোলা।।
এ হেন বাক্য শুনিয়ে
গোঁসাই মৃদু হাসিয়ে
দুই কর পাতিল অঞ্জলি।
গোঁসাই না কহে বাণী
অমনি সুভদ্রা ধনী
হাঁড়ি ধরে গোলা দেয় ঢালি।।
গোঁসাইর নাহি দুঃখ
অমনি দিল চুমুক
সে অঞ্জলি খাইল তখন।
পুনশ্চ অঞ্জলি দিলে
সে অঞ্জলিও খাইলে
একবিন্দু হ’ল না পতন।।
পুনশ্চ কহে বৈষ্ণবী
কিরে বাছা আরো খাবি
অমনি গোঁসাই পাতে হাত।
দিলেন হাঁড়ি ঢালিয়ে
তৃতীয় অঞ্জলি খেয়ে
গোঁসাই করিল প্রণিপাত।।
সুভদ্রা কহিছে ম’তো দেখি তোর ভক্তি
কত
হস্ত ধৌত না করিও ধন।
গোঁসাই কহে কি করি
বুড়ি কহে শিরোপরি
হস্তদ্বয় করহ মার্জন।।
সুভদ্রা কহিল যাহা
গোস্বামী করিল তাহা
উত্তরাভিমুখে চলি যায়।
সদা মুখে হরিনাম
আসিল পদুমা গ্রাম
ফেলারাম বিশ্বাস আলয়।।
এদিকে সুভদ্রা গিয়ে
হস্তপদ পাখলিয়ে
করেতে লইল জপ মালা।
মালা জপিতে জপিতে
কম্প উঠি আকস্মাতে
গৃহমাঝে প্রবেশ করিলা।।
উঠিল পেটে বেদনা
তাহা না হয় সান্তনা
সুভদ্রা কহিছে হায় হায়।
উদর বেদনা জ্বালা
সেই গোময়ের গোলা
ভেদ আর বমি সদা হয়।।
নিতাই চৈতন্য বলে
ভাসে দু’নয়ন জলে
কিছুতেই না হয় প্রতিকার।
যত বলে শ্রীচৈতন্য
বেদনা বাড়ে দ্বৈগুণ্য
ভেদ বমি হয় বার বার।।
মৃত্যুঞ্জয় এসে ঘরে
তাহা নিরীক্ষণ করে
বলে কিবা হইল মায়ের।
গোময়ের গোলা যত
ভেদবমি অবিরত
বুঝিতে না পারি কর্ম ফের।।
মৃত্যুঞ্জয়ের বনিতা
বলে কিবা কহিব তা
দুষ্কার্য করেছে ঠাকুরানী।
যেমন করেছে কার্য
তাহা নাহি মনে গ্রাহ্য
কর্মফল ফলেছে অমনি।।
গোস্বামী গোলোক এসে
মা ব’লে প্রণামি শেষে
ঠাকুরানীর খায় পদধূলা।
ঠাকুরানী ক্রোধ ক’রে মোদের গোঁসাইজীরে
খাওয়াইছে গোময়ের গোলা।।
সেই গোলা উদ্বমন
হইতেছে সর্বক্ষণ
ভেদ হইতেছে সেই গোলা।
গলিত ঘর্ম শরীর
হ’তেছে ঠাকুরানীর
উদর বেদনা অঙ্গজ্বালা।।
মৃত্যুঞ্জয় শুনে তাই
গিয়া জননীর ঠাই
বলে মাতা কহ সমাচার।
শুনিয়া সুভদ্রা ধনী
কাতরে কহিছে বাণী
বলে বাবা কি বলিব আর।।
এসেছিল সে গোলোক
মাধুর্যভাবের লোক
জলন্ত পাবক প্রায় আজ।
আগে ক’রে দণ্ডবৎ শেষে দিল পায়ে হাত
আমি বলি কি করিস কাজ।।
লইতে পায়ের ধূলা
খাইল গোময় গোলা
ভাব ধরে হরি হরি বোলা।
দেখি তোর কত ভক্তি
ধূলাতে কতই আর্তি
খা দেখি এ গোময়ের গোলা।।
দিলাম গোময় গুলি
খাইল তিনটি অঞ্জলি
জ্বলে মম অস্থি চর্ম মেদ।
হস্তপদ চক্ষু জ্বালা
সেই গোময়ের গোলা
হইতেছে বমি আর ভেদ।।
ওরে বাপ মৃত্যুঞ্জয়
পাগল গেল কোথায়
সে না এলে আমি মরি প্রাণে।
করেছি যেমন কাজ
আমার মুণ্ডেতে বাজ
মরি বাঁচি দেখা তারে এনে।।
নির্মল প্রেমের সাধু
আমি তারে শুধু শুধু
করিয়াছি নিন্দন ও ভর্ৎসন।
সাধু নিন্দা মহাপাপ
ভুঞ্জিতেছি সেই পাপ
করি তার চরণ বন্দন।।
কথাশুনি মৃত্যুঞ্জয়
দ্রুত অন্বেষণে যায়
কোথা সেই গোলোক গোঁসাই।
পদুমায় দেখা পেয়ে
পদে দণ্ডবৎ হ’য়ে
জানাইল গোঁসাইর ঠাই।।
গোস্বামী গোলোক গিয়ে নিকটে
উদয় হ’য়ে
সুভদ্রাকে দেখা দিয়া কয়।
শুনগো মা ঠাকুরানী
আমি কিছু নাহি জানি
সব হরিচাঁদের ইচ্ছায়।।
বৈষ্ণবী কহিছে বাপ
আমার হ’য়েছে পাপ
সকলই ত’ প্রভুর ইচ্ছায়।
ভাগবতে বাক্য শুনি
আছে মহাপ্রভু বাণী
মহাপাপ বৈষ্ণব নিন্দায়।।
বৈষ্ণব নিন্দুক জন
মিথ্যা এ সাধন ভজন
হরি তারে নাহি ফিরে চায়।
জনমে জনমে তার
নাহি পাপের উদ্ধার
বল মম কি হবে উপায়।।
দেরে বাপ পদতরী
আমার হৃদয়পরি
তরীর বৈষ্ণব অপরাধে।
ক্ষম মম অপরাধ
তুলে গোস্বামীর পদ
বৈষ্ণবী ধরিল নিজ হৃদে।।
সব জ্বালা দূরে গেল
বৈষ্ণবী ভাল হইল
হরি ব’লে চক্ষে বহে নীর।
কহিছেন কাঁদি কাঁদি
ধন্য ধন্য ওঢ়াকাঁদি
শুদ্ধ হ’ল আমার শরীর।।
হরিচাঁদ ভক্ত যারা
পতিত পাবন তারা
বিষ্ণু অবতার বিষ্ণু অংশ।
বীর রসে ধীরোত্তম
সবে বিষ্ণু পরাক্রম
বিষ্ণু তেজ সব বিষ্ণু বংশ।।
যেমন শ্রীগৌরচন্দ্র
আর প্রভু নিত্যানন্দ
ভক্তবৃন্দ সেই অবতার।
হৃদয় শোধন করি
বলাইল হরি হরি
এহেন দয়াল নাহি আর।।
সেই প্রেম পেয়েছিল
তাহা জীবে পাসরিল
ভুলিল প্রেমের মধুরত্ব।
ত্যজিয়া অমৃত ফল
জীব গেল রসাতল
বিষ ফলে হইল প্রমত্ত।।
খণ্ডাইতে কর্ম বন্ধ
সেই প্রভু হরিশ্চন্দ্র
এবে হ’ল যশোমন্ত সুত।
হরিচাঁদ নাম ধরি
ওঢ়াকাঁদি অবতরী
নাম প্রচারিল প্রেম যুত।।
তার যত ভক্তগণ
তারা ভুবন পাবন
ব্রহ্মাণ্ড তারিতে শক্তি
ধরে।
আমি’ত অবিশ্বাসিনী শ্রীহরি
ভক্ত দ্বেষিণী
শোধিল আমার কলেবরে।।
গোলোক সুভদ্রাখ্যান
সুধার সমুদ্রবান
পান কর প্রাণ বাঞ্ছাতরী।
কহিছে তারকচন্দ্র
মহানন্দের আনন্দ
সাধু সব পিয় কর্ণভরি।।
No comments:
Post a Comment